‘মুদ্রাস্ফীতির
অব্যাহত চাপ রেখে সরকারগুলো খুব গোপনে, অলক্ষ্যে তাদের নাগরিকদের সম্পদের
একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হজম করে ফেলে। এ পদ্ধতিতে হজম বা বাজেয়াপ্ত করার এ
ঘটনা ঘটে নির্বিচারে। এই প্রক্রিয়ায় যখন বহুসংখ্যক মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত হয়,
তখন কিছুসংখ্যক সম্পদশালী হয়।’ কথাটা কেইনস বলেছিলেন ১৯১৯ সালে প্রকাশিত
দ্য ইকোনমিক কনসিকুয়েন্স অব পিস গ্রন্থে। অর্থনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত তাই
নিছক অর্থনীতির বিষয় নয়, এটা সমাজের শক্তি সমাবেশ ও ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে
সম্পর্কিত। অনেকের উৎপাদিত সম্পদ কিছুজনের হাতে স্থানান্তরিত হওয়ার
প্রক্রিয়া কিংবা কিছুজনের স্বার্থে বহুজনের জীবন বিপন্ন করা কোনো
স্বয়ংক্রিয় ঘটনা নয়, তা নির্দিষ্ট নীতি, পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রের নানা
কর্মকাণ্ডের ফল।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ও বিনিয়োগের সংকট এখন একই সঙ্গে চলছে। মূলধারার অর্থশাস্ত্র বলে, মুদ্রাস্ফীতি হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ে। অনেক সময় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর যুক্তিতে মুদ্রাস্ফীতিকে একটি উপায় হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। মুদ্রাস্ফীতির পক্ষে মুদ্রানীতি ও অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু শাস্ত্রের অসুখ ও ওষুধ-সম্পর্কিত এই তত্ত্ব সত্তরের দশক থেকেই বিপদাপন্ন, স্ট্যাগফ্লেশন নামের নতুন আপদ হাজির হওয়ার কারণে। মুদ্রাস্ফীতি যখন বিনিয়োগ-মন্দা কাটানোর ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার কথা, তখন যদি মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগ মন্দা পাশাপাশি চলতে থাকে, তখনই এই বিশেষ সংকটের উদ্ভব ঘটে, তারই নাম স্ট্যাগফ্লেশন। বাংলাদেশে আমরা দেখছি একদিকে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, অন্যদিকে বিনিয়োগে শ্লথগতি দেখা দিচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি অথচ বিনিয়োগের অর্থ নেই! তারল্যসংকট।
বিপুল বিনিয়োগ হয়েছিল শেয়ারবাজারে। চোরাই টাকা তো ছিলই, দেশের সব প্রান্তের সব আয়ের মানুষ যেন তাদের সহায়সম্বল নিয়ে শেয়ারবাজারে হাজির হয়, তার জন্য সরকারই সব রকম ব্যবস্থা করেছিল। ব্যাংক বা সরকারি সঞ্চয়ের সব ক্ষেত্রে সুদের হার কমানো হয়েছিল, জেলায় জেলায় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইত্যাদি। কাজ নেই, দ্রুত আয়ের তাগিদ আর এসব সুবিধায় আকৃষ্ট হয়ে সব রকম সঞ্চয় ও ঋণ নিয়ে মানুষ জমায়েত হয়েছিল শেয়ারবাজারে। তারপর শুরু হলো পতন। খুব দ্রুত দেশের লাখ লাখ মানুষের সম্পদ স্থানান্তরিত হয়ে গেল কিছু ব্যক্তির হাতে। সরকার বলতে থাকল, আমাদের কিছু করার নেই। তদন্ত কমিটি কিছু কারণ বের করল, কিছু গোষ্ঠীকে চিহ্নিতও করল; কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না বলে পণ করেছে। সেই টাকা কোথায় গেল, তারও কোনো হদিস নেই। এ রকম ধারণা করার যুক্তিসংগত কারণ আছে যে সেই বিপুল পরিমাণ টাকা ডলারে পরিণত করে বাইরে পাচার করা বর্তমান ডলারসংকটের অন্যতম কারণ।
মূল কারণ দূর করায় সরকারের অনীহার কারণে দেশের শেয়ারবাজারের আছড়ে পড়া অবস্থারও তাই কোনো পরিবর্তন নেই। ইতিমধ্যে দুজনের আত্মহত্যার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। লাখ লাখ পরিবার অভূতপূর্ব সংকটের মুখে। সম্পদের বদলে তাদের ঘাড়ে এখন ঋণ। স্বাচ্ছন্দ্যের বদলে তাদের এখন হাহাকার। এমএলএম নামের দ্রুত টাকা বানানোর নানা প্রক্রিয়ায়ও অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছে। প্রায়ই তাঁদের হাহাকার পত্রিকায় আসে, শহীদ মিনারে তাঁরা অনশন করেন। সরকার নির্লিপ্ত, মাঝেমধ্যে মুখের দু-একটা কথা। কারণ বোধগম্য, এসবের সঙ্গে নানা প্রভাবশালী লোক জড়িত।
টাকার মূল্যমানের অবনতি গত কয়েক মাসে অনেক দ্রুত ঘটেছে। টাকার তুলনায় ডলারের দাম ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় টাকার অঙ্কে রপ্তানিকারক পোশাক কারখানার মালিক ও প্রবাসীদের আয় বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের আপেক্ষিক আয় কমেছে। অন্যদিকে আমদানি করা দ্রব্যাদির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় থেকে শুরু করে গৃহস্থালির ব্যয়—সবকিছুই বেড়েছে, সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর চাপ বেড়েছে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস দুটি: এক. প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ এবং দুই. তৈরি পোশাক রপ্তানি। এই দুই খাতে দিবারাত্র শ্রম দিচ্ছে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। কোটি মানুষ হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গড়ে তুলছে। আর যাদের ঘরে সম্পদের পাহাড়ের নিরাপত্তার জন্য এই মজুদের বড় অংশ বাইরে চলে যাচ্ছে, তাদের সংখ্যা হাজারও হবে না।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে সরকারেরও উদ্বেগ প্রকাশিত হচ্ছে। তবে তা রূপান্তরিত হচ্ছে আইএমএফের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ সংগ্রহে নানা তৎপরতায়। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান যখন ঋণ দেয়, তার আওয়াজ বহুদিন থেকে চলতে থাকে। ১০০ টাকা ঋণ দিলে তা নিয়ে এতবার এত দিন ধরে কথা হতে থাকে, তা ১০ হাজার টাকার ভাব তৈরি করে। মনে হয় সেটাই একমাত্র উদ্ধারের পথ। আইএমএফের এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ঋণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি, কিন্তু তাদের হাসিমুখ প্রার্থনায় কয়েক দফা তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, সামনে আরও বাড়ানো হবে। আইএমএফ ঋণ দিতে বহুদিন ধরেই ধরনা দিচ্ছে। এসব ঋণ দেওয়ার সঙ্গে তাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। সে জন্য এসব ঋণ নিয়ে কোনো দেশ তার সংকট থেকে মুক্ত হয়নি, বরং আরও ঋণগ্রস্ততার দুষ্টচক্রে পতিত হয়েছে। আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশ তার সাক্ষী।
দেশের বৈদেশিক ঋণ যা ‘বিদেশি সাহায্য’ নামে পরিচিত, তার জন্য আমরা অনেকের হাহাকার শুনি। কিন্তু আমরা যদি বছরে গড়পড়তা নিট বৈদেশিক তহবিলপ্রবাহ বিবেচনা করি, তাহলে তার ১০ গুণ বেশি অর্থ প্রবাসীদের থেকেই আসে। এখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। তার মানে আইএমএফের কাছ থেকে বহু রকম শর্ত ও আওয়াজ দিয়ে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তা প্রবাসীরা প্রতি এক মাসে নীরবে দেশে পাঠাচ্ছেন। আইএমএফ এই ঋণ দেবে তিন বছরে, অনেক শর্ত বাস্তবায়ন করার পর। অর্থাৎ তার প্রতিবছরে ছাড় করা ডলার হবে প্রবাসীদের প্রতি ১০ দিনে পাঠানো অর্থের সমান। তার পরও অর্থমন্ত্রী এই ঋণ পাওয়ার জন্য অনড়। তা নিশ্চিত করার যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তাতে অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়, পরিবহন ব্যয় ও জীবনযাত্রার ব্যয় সবই বাড়ছে, সামনে আরও বাড়বে। টানতে না পেরে ঋণগ্রস্ততার চাপ বাড়ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের।
অর্থমন্ত্রী এতেও ক্ষান্ত নন। তিনি সার্বভৌম ঋণ নেওয়ার তোড়জোড় করছেন। এটা হচ্ছে সার্বভৌমত্ব বন্ধক দিয়ে ঋণ। তাঁর দাবি, এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে! ঋণগ্রহণের ব্যাপারে সরকারের অতিআগ্রহ বহুদিক থেকেই বিপদ ডেকে আনছে। ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য ভারতের কাছ থেকেই ঋণ নেওয়া হয়েছে। যে ঋণ অনুযায়ী ইট-বালু, সিমেন্টও তাদের কাছ থেকেই আনতে হবে। সুদও দিতে হবে, জরিমানাও। উল্লেখ্য, ভারতের জন্য সুবিধা দিতে সরকারের উদারতা সীমাহীন, ট্রানজিট নিয়ে যথাযথ চুক্তি না হলেও তাদের ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য তিতাস নদীর প্রবাহ বন্ধ করে রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে।
দেশের ব্যাংক থেকেও সরকার ঋণগ্রহণে আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এর কারণ হিসেবে বাড়তি তেল এনে বিদ্যুৎসংকট সমাধানের কথা বলা হয়। বরাবরই বাংলাদেশের আমদানির একটা বড় অংশ তেল। এখন তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তেল আমদানিনির্ভরতা বিপজ্জনক। কেননা আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম সব সময়ই অস্থিতিশীল, ভবিষ্যতে আরও হবে। তেল নিয়ে সংঘাত, যুদ্ধ এবং সর্বোপরি ফাটকাবাজারির কারণে এই সংকট আরও বাড়বে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো দেশকে তার নিজের জ্বালানি সম্পদ শতভাগ দেশে রাখতে হবে, কোনো রকম রপ্তানিমুখী চুক্তি যাতে না হয়, এমন ধরনের চুক্তি যাতে না হয়, যাতে ২৫ টাকার গ্যাস ৩০০ টাকায় কিনে বিদ্যুৎ বা গ্যাসের দাম বাড়ে এবং শেষ পর্যন্ত উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে সব নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাস, কয়লা দেশের মধ্যে শতভাগ ব্যবহারের নিশ্চয়তা এবং জাতির সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কম দামে জ্বালানি-শক্তি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু এ দেশের কোনো সরকারেরই সেদিকে মন নেই।
সংকট সমাধান করতে গিয়ে নতুন নতুন সংকটের বোঝা তৈরির নীতির একটি দৃষ্টান্ত রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎসংকটের সমাধানের নামে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদ্যুৎসংকটের সমাধান অস্থায়ী বা খণ্ড খণ্ডভাবে হয় না। তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য অনেক ধরনের বিষয় আছে। স্বল্প মেয়াদে বিদ্যুৎসংকট সমাধানের জন্য অনেক সহজ বিকল্প ছিল। তাতে আমদানিনির্ভরতা বাড়ত না, ঋণগ্রস্ততা এই মাত্রায় যেত না, তেল-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চাপ তৈরি হতো না, আবার দেশের সক্ষমতাও বাড়ত। কিন্তু সরকার তার পরিবর্তে কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখতে গিয়ে দেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও সংকটের বোঝা চাপিয়েছে।
ভুলনীতি ও দুর্নীতির কারণে দেশ যেভাবে ক্রমেই ঋণনির্ভর হচ্ছে এবং সেই ঋণের টাকায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের যে রকম শানশওকত চলছে, তাতে গণি মিয়ার কথা মনে পড়ে। তাঁর গল্প ছোটবেলায় আমরা অনেকেই পড়েছি। ‘গণি মিয়া’ ছিলেন একজন কৃষক। কৃষক হিসেবে তিনি মোটামুটি ভালোই চলছিলেন। কিন্তু ভোগবিলাসের প্রতি তাঁর বিশেষ আসক্তি ছিল। কৃষির আয় থেকে তা সম্ভব ছিল না। গল্পে আছে, তাঁর আসক্তি এতই প্রবল ছিল যে, তিনি ঋণ করে হলেও ঘি খেতেন। ঋণের টাকা খুব সহজ, ব্যয়ের সময় গায়ে লাগে না। কিন্তু ঋণ বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে সুদও। যখন সেই ঋণ শোধ করার সময় হলো তখনই দেখা দিল বিপত্তি। সুদসহ ঋণের টাকা শোধ করতে করতে ফতুর হলেন তিনি। ঋণ করে ঘি খেয়ে শেষে পথে বসলেন কৃষক গণি মিয়া। এই ‘গণি মিয়ার’ সঙ্গে ‘মুহিত সাহেবের’ তফাত কী? তফাত আছে।
গণি মিয়া ঋণ করে নিজে ভোগ করেছেন, নিজেই তার মাশুল দিয়েছেন। কিন্তু মুহিত সাহেবরা যে ঋণের বোঝা তৈরি করছেন, তাতে তাঁর বা তাঁদের কোনো ঝুঁকি বা বিপদ নেই, মাশুলও তাঁদের দিতে হবে না। কতিপয় গোষ্ঠী বা সরকারের কতিপয় লোকজন সুবিধা ভোগ করবে ঠিকই। কিন্তু এই ঋণ ও তার ব্যয় সম্পর্কে জানার বা এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোনো এখতিয়ার যাদের নেই, মাশুল দিতে হচ্ছে ও হবে সেই জনগণকে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ও বিনিয়োগের সংকট এখন একই সঙ্গে চলছে। মূলধারার অর্থশাস্ত্র বলে, মুদ্রাস্ফীতি হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ে। অনেক সময় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর যুক্তিতে মুদ্রাস্ফীতিকে একটি উপায় হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। মুদ্রাস্ফীতির পক্ষে মুদ্রানীতি ও অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু শাস্ত্রের অসুখ ও ওষুধ-সম্পর্কিত এই তত্ত্ব সত্তরের দশক থেকেই বিপদাপন্ন, স্ট্যাগফ্লেশন নামের নতুন আপদ হাজির হওয়ার কারণে। মুদ্রাস্ফীতি যখন বিনিয়োগ-মন্দা কাটানোর ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার কথা, তখন যদি মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগ মন্দা পাশাপাশি চলতে থাকে, তখনই এই বিশেষ সংকটের উদ্ভব ঘটে, তারই নাম স্ট্যাগফ্লেশন। বাংলাদেশে আমরা দেখছি একদিকে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, অন্যদিকে বিনিয়োগে শ্লথগতি দেখা দিচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি অথচ বিনিয়োগের অর্থ নেই! তারল্যসংকট।
বিপুল বিনিয়োগ হয়েছিল শেয়ারবাজারে। চোরাই টাকা তো ছিলই, দেশের সব প্রান্তের সব আয়ের মানুষ যেন তাদের সহায়সম্বল নিয়ে শেয়ারবাজারে হাজির হয়, তার জন্য সরকারই সব রকম ব্যবস্থা করেছিল। ব্যাংক বা সরকারি সঞ্চয়ের সব ক্ষেত্রে সুদের হার কমানো হয়েছিল, জেলায় জেলায় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইত্যাদি। কাজ নেই, দ্রুত আয়ের তাগিদ আর এসব সুবিধায় আকৃষ্ট হয়ে সব রকম সঞ্চয় ও ঋণ নিয়ে মানুষ জমায়েত হয়েছিল শেয়ারবাজারে। তারপর শুরু হলো পতন। খুব দ্রুত দেশের লাখ লাখ মানুষের সম্পদ স্থানান্তরিত হয়ে গেল কিছু ব্যক্তির হাতে। সরকার বলতে থাকল, আমাদের কিছু করার নেই। তদন্ত কমিটি কিছু কারণ বের করল, কিছু গোষ্ঠীকে চিহ্নিতও করল; কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না বলে পণ করেছে। সেই টাকা কোথায় গেল, তারও কোনো হদিস নেই। এ রকম ধারণা করার যুক্তিসংগত কারণ আছে যে সেই বিপুল পরিমাণ টাকা ডলারে পরিণত করে বাইরে পাচার করা বর্তমান ডলারসংকটের অন্যতম কারণ।
মূল কারণ দূর করায় সরকারের অনীহার কারণে দেশের শেয়ারবাজারের আছড়ে পড়া অবস্থারও তাই কোনো পরিবর্তন নেই। ইতিমধ্যে দুজনের আত্মহত্যার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। লাখ লাখ পরিবার অভূতপূর্ব সংকটের মুখে। সম্পদের বদলে তাদের ঘাড়ে এখন ঋণ। স্বাচ্ছন্দ্যের বদলে তাদের এখন হাহাকার। এমএলএম নামের দ্রুত টাকা বানানোর নানা প্রক্রিয়ায়ও অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছে। প্রায়ই তাঁদের হাহাকার পত্রিকায় আসে, শহীদ মিনারে তাঁরা অনশন করেন। সরকার নির্লিপ্ত, মাঝেমধ্যে মুখের দু-একটা কথা। কারণ বোধগম্য, এসবের সঙ্গে নানা প্রভাবশালী লোক জড়িত।
টাকার মূল্যমানের অবনতি গত কয়েক মাসে অনেক দ্রুত ঘটেছে। টাকার তুলনায় ডলারের দাম ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় টাকার অঙ্কে রপ্তানিকারক পোশাক কারখানার মালিক ও প্রবাসীদের আয় বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের আপেক্ষিক আয় কমেছে। অন্যদিকে আমদানি করা দ্রব্যাদির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় থেকে শুরু করে গৃহস্থালির ব্যয়—সবকিছুই বেড়েছে, সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর চাপ বেড়েছে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস দুটি: এক. প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ এবং দুই. তৈরি পোশাক রপ্তানি। এই দুই খাতে দিবারাত্র শ্রম দিচ্ছে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। কোটি মানুষ হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গড়ে তুলছে। আর যাদের ঘরে সম্পদের পাহাড়ের নিরাপত্তার জন্য এই মজুদের বড় অংশ বাইরে চলে যাচ্ছে, তাদের সংখ্যা হাজারও হবে না।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে সরকারেরও উদ্বেগ প্রকাশিত হচ্ছে। তবে তা রূপান্তরিত হচ্ছে আইএমএফের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ সংগ্রহে নানা তৎপরতায়। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান যখন ঋণ দেয়, তার আওয়াজ বহুদিন থেকে চলতে থাকে। ১০০ টাকা ঋণ দিলে তা নিয়ে এতবার এত দিন ধরে কথা হতে থাকে, তা ১০ হাজার টাকার ভাব তৈরি করে। মনে হয় সেটাই একমাত্র উদ্ধারের পথ। আইএমএফের এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ঋণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি, কিন্তু তাদের হাসিমুখ প্রার্থনায় কয়েক দফা তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, সামনে আরও বাড়ানো হবে। আইএমএফ ঋণ দিতে বহুদিন ধরেই ধরনা দিচ্ছে। এসব ঋণ দেওয়ার সঙ্গে তাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। সে জন্য এসব ঋণ নিয়ে কোনো দেশ তার সংকট থেকে মুক্ত হয়নি, বরং আরও ঋণগ্রস্ততার দুষ্টচক্রে পতিত হয়েছে। আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশ তার সাক্ষী।
দেশের বৈদেশিক ঋণ যা ‘বিদেশি সাহায্য’ নামে পরিচিত, তার জন্য আমরা অনেকের হাহাকার শুনি। কিন্তু আমরা যদি বছরে গড়পড়তা নিট বৈদেশিক তহবিলপ্রবাহ বিবেচনা করি, তাহলে তার ১০ গুণ বেশি অর্থ প্রবাসীদের থেকেই আসে। এখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। তার মানে আইএমএফের কাছ থেকে বহু রকম শর্ত ও আওয়াজ দিয়ে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তা প্রবাসীরা প্রতি এক মাসে নীরবে দেশে পাঠাচ্ছেন। আইএমএফ এই ঋণ দেবে তিন বছরে, অনেক শর্ত বাস্তবায়ন করার পর। অর্থাৎ তার প্রতিবছরে ছাড় করা ডলার হবে প্রবাসীদের প্রতি ১০ দিনে পাঠানো অর্থের সমান। তার পরও অর্থমন্ত্রী এই ঋণ পাওয়ার জন্য অনড়। তা নিশ্চিত করার যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তাতে অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়, পরিবহন ব্যয় ও জীবনযাত্রার ব্যয় সবই বাড়ছে, সামনে আরও বাড়বে। টানতে না পেরে ঋণগ্রস্ততার চাপ বাড়ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের।
অর্থমন্ত্রী এতেও ক্ষান্ত নন। তিনি সার্বভৌম ঋণ নেওয়ার তোড়জোড় করছেন। এটা হচ্ছে সার্বভৌমত্ব বন্ধক দিয়ে ঋণ। তাঁর দাবি, এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে! ঋণগ্রহণের ব্যাপারে সরকারের অতিআগ্রহ বহুদিক থেকেই বিপদ ডেকে আনছে। ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য ভারতের কাছ থেকেই ঋণ নেওয়া হয়েছে। যে ঋণ অনুযায়ী ইট-বালু, সিমেন্টও তাদের কাছ থেকেই আনতে হবে। সুদও দিতে হবে, জরিমানাও। উল্লেখ্য, ভারতের জন্য সুবিধা দিতে সরকারের উদারতা সীমাহীন, ট্রানজিট নিয়ে যথাযথ চুক্তি না হলেও তাদের ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য তিতাস নদীর প্রবাহ বন্ধ করে রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে।
দেশের ব্যাংক থেকেও সরকার ঋণগ্রহণে আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এর কারণ হিসেবে বাড়তি তেল এনে বিদ্যুৎসংকট সমাধানের কথা বলা হয়। বরাবরই বাংলাদেশের আমদানির একটা বড় অংশ তেল। এখন তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তেল আমদানিনির্ভরতা বিপজ্জনক। কেননা আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম সব সময়ই অস্থিতিশীল, ভবিষ্যতে আরও হবে। তেল নিয়ে সংঘাত, যুদ্ধ এবং সর্বোপরি ফাটকাবাজারির কারণে এই সংকট আরও বাড়বে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো দেশকে তার নিজের জ্বালানি সম্পদ শতভাগ দেশে রাখতে হবে, কোনো রকম রপ্তানিমুখী চুক্তি যাতে না হয়, এমন ধরনের চুক্তি যাতে না হয়, যাতে ২৫ টাকার গ্যাস ৩০০ টাকায় কিনে বিদ্যুৎ বা গ্যাসের দাম বাড়ে এবং শেষ পর্যন্ত উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে সব নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাস, কয়লা দেশের মধ্যে শতভাগ ব্যবহারের নিশ্চয়তা এবং জাতির সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কম দামে জ্বালানি-শক্তি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু এ দেশের কোনো সরকারেরই সেদিকে মন নেই।
সংকট সমাধান করতে গিয়ে নতুন নতুন সংকটের বোঝা তৈরির নীতির একটি দৃষ্টান্ত রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎসংকটের সমাধানের নামে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদ্যুৎসংকটের সমাধান অস্থায়ী বা খণ্ড খণ্ডভাবে হয় না। তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য অনেক ধরনের বিষয় আছে। স্বল্প মেয়াদে বিদ্যুৎসংকট সমাধানের জন্য অনেক সহজ বিকল্প ছিল। তাতে আমদানিনির্ভরতা বাড়ত না, ঋণগ্রস্ততা এই মাত্রায় যেত না, তেল-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চাপ তৈরি হতো না, আবার দেশের সক্ষমতাও বাড়ত। কিন্তু সরকার তার পরিবর্তে কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখতে গিয়ে দেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও সংকটের বোঝা চাপিয়েছে।
ভুলনীতি ও দুর্নীতির কারণে দেশ যেভাবে ক্রমেই ঋণনির্ভর হচ্ছে এবং সেই ঋণের টাকায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের যে রকম শানশওকত চলছে, তাতে গণি মিয়ার কথা মনে পড়ে। তাঁর গল্প ছোটবেলায় আমরা অনেকেই পড়েছি। ‘গণি মিয়া’ ছিলেন একজন কৃষক। কৃষক হিসেবে তিনি মোটামুটি ভালোই চলছিলেন। কিন্তু ভোগবিলাসের প্রতি তাঁর বিশেষ আসক্তি ছিল। কৃষির আয় থেকে তা সম্ভব ছিল না। গল্পে আছে, তাঁর আসক্তি এতই প্রবল ছিল যে, তিনি ঋণ করে হলেও ঘি খেতেন। ঋণের টাকা খুব সহজ, ব্যয়ের সময় গায়ে লাগে না। কিন্তু ঋণ বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে সুদও। যখন সেই ঋণ শোধ করার সময় হলো তখনই দেখা দিল বিপত্তি। সুদসহ ঋণের টাকা শোধ করতে করতে ফতুর হলেন তিনি। ঋণ করে ঘি খেয়ে শেষে পথে বসলেন কৃষক গণি মিয়া। এই ‘গণি মিয়ার’ সঙ্গে ‘মুহিত সাহেবের’ তফাত কী? তফাত আছে।
গণি মিয়া ঋণ করে নিজে ভোগ করেছেন, নিজেই তার মাশুল দিয়েছেন। কিন্তু মুহিত সাহেবরা যে ঋণের বোঝা তৈরি করছেন, তাতে তাঁর বা তাঁদের কোনো ঝুঁকি বা বিপদ নেই, মাশুলও তাঁদের দিতে হবে না। কতিপয় গোষ্ঠী বা সরকারের কতিপয় লোকজন সুবিধা ভোগ করবে ঠিকই। কিন্তু এই ঋণ ও তার ব্যয় সম্পর্কে জানার বা এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোনো এখতিয়ার যাদের নেই, মাশুল দিতে হচ্ছে ও হবে সেই জনগণকে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন