আনু মুহাম্মদ
বাজেটের প্রধান অংশ রাজস্ব আয় ও ব্যয়। সরকারের রাজস্ব আয় বলতে যা বোঝানো হয় তাকে আমরা অন্যদিক থেকে বলতে পারি কর, শুল্ক, ফিসহ নানাভাবে সরকারকে দেওয়া জনগণের অর্থ। আর রাজস্ব ব্যয় হলো, সরকারি প্রশাসন-প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ। সরকারি-আধাসরকারি পর্যায়ে সব ব্যয় জনগণের অর্থেই পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে যে কর-শুল্ক দেয় তা গত চার বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আদায়কৃত কর ও শুল্কের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। ২০১১-১২ পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অন্যান্য রাজস্ব মিলিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬৪ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা এবং এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। এই বছর কর রাজস্ব ২০ হাজার কোটি টাকাসহ অতিরিক্ত আরও ২৫ হাজার কোটি টাকার বোঝা জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে। তাতে ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হবে এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এটাও আদায় হবে, হয়তো বেশিই হবে।
তবে জনগণের বোঝা এখানেই শেষ হবে না। এবারও জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ভুল নীতি, ক্ষতিকর চুক্তি ও দুর্নীতির কারণে যে বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তার চাপ কমাতে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আয়োজন করা হচ্ছে। গত বছরের মতো এবারও তা করা হচ্ছে বাজেট ঘোষণার বাইরে। এগুলো নতুন কর-শুল্কের চেয়েও ব্যাপকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে। শিল্প, কৃষিসহ সব উৎপাদনশীল খাত আরও কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবে।
অথচ যাদের হাতে দেশের আয় ও সম্পদের বৃহদাংশ, তারা কিন্তু এখনো করজালের বাইরে। সরকারের সমীক্ষা ও অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিশাল অঙ্কের অর্থ সরকারের হিসাবে নেই। এটা হবে প্রায় পাঁচ লাখ থেকে সাত লাখ কোটি টাকা। এই আয়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপ্রদর্শিত আয়’, অর্থশাস্ত্রে এর আরেকটি নাম, ‘কালোটাকা’। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হতে পারে পরিশ্রমলব্ধ বৈধ আয়, কর না দেওয়ার কারণে তা এখন ‘অপ্রদর্শিত’ তালিকাভুক্ত। তবে এই টাকার বড় অংশের যথার্থ নাম হবে ‘চোরাই টাকা’, যা চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, ক্ষমতাপ্রয়োগ, জালিয়াতি, দখল ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে অর্জিত। এগুলোর মধ্যে আছে ঘুষ, নিয়োগবাণিজ্য, কমিশন, রাষ্ট্রীয় বা সর্বজন সম্পদ আত্মসাৎ, উর্দিপরা ও উর্দিছাড়াদের চাঁদাবাজি, কাজ না করে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ ভাগাভাগি, বাণিজ্যে ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিং ইত্যাদি। এসব কাজ ক্ষমতাবানদের পক্ষেই করা সম্ভব, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া এগুলো টিকতে পারে না।
এই বিশাল সম্পদ ও অর্থ করদানের আওতার বাইরে এবং তা অব্যাহতভাবে ক্রমবর্ধমান। গত কয়েক দশকে যে উন্নয়ন গতিধারা সরকার নির্বিশেষে পুষ্ট হচ্ছে এটা তারই ফল। অর্থমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে যখন বলেন, ‘এই উন্নয়ন গতিধারা অব্যাহত থাকবে’, তখন আতঙ্কিত হই। বুঝি সামনের বছর বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে, প্রকল্প-অপ্রকল্প ব্যয়ের মধ্য দিয়ে চোরাই টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে।
রাজস্ব আয়ের এই সম্ভাব্য বিশাল উৎস শুধু যে সরকারি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে তা নয়, এই অর্থ বিভিন্নভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়। এভাবে দেশি ও প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করা বিদেশি মুদ্রার মজুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খোরাক হচ্ছে চোরাই টাকার মালিকদের। তারপর এর ঘাটতি পূরণ করতে নেওয়া হচ্ছে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ।
প্রতিবছর বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, অনেক প্রকল্পের সমাবেশ। এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে এবারও অনেক প্রশ্ন উঠেছে। বাস্তবায়ন বলতে যদি টাকা খরচ বোঝায়, প্রতি বছরেই তা জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়, যদিও এপ্রিল মাস নাগাদ শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ খরচ হয়। খরচ সম্পন্ন হওয়া আর প্রকল্প সম্পন্ন হওয়া এক কথা নয়। খুব কম প্রকল্পই বাস্তবায়িত হচ্ছে, কিন্তু খরচ হয় পুরোটাই। এর ফলে পরের বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পূর্ণ হয় আগের বছরের অসমাপ্ত প্রকল্প দিয়ে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রথম বাজেট বক্তৃতায় এই অবস্থার পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিন বছর পর সর্বশেষ তিনি যে বাজেট উপহার দিলেন, সেখানে পরিস্থিতি একই রকম আছে। এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে শতকরা ৫০ ভাগের একটু বেশি। আমরা জানি, জুন পর্যন্ত সংশোধিত বাজেটের পুরোটা খরচ হবে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ এই বছরের কিংবা আরও পুরোনো অসমাপ্ত প্রকল্প। নতুনের সঙ্গে অনেকগুলো অসমাপ্ত প্রকল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে সামনের বছরের ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি’।
অথচ গত বেশ কয়েক বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থবরাদ্দ নিয়ে নানা নীতি, নিয়ম, প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ‘দাতা’ সংস্থাগুলোর ‘নজরদারি’র নানা শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে, সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশে-বিদেশে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এগুলোতেও বছর বছর বিদেশি ঋণসহ বরাদ্দ কম দেওয়া হয়নি। ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্স নামে বিদেশি ঋণ অনুদান, সেমিনার-ওয়ার্কশপ, বিদেশি কনসালট্যান্ট আনা, গাড়ি কেনা, বিদেশ সফর—সবই হয়েছে। এতসব প্রহরী, এতসব পরীক্ষা, তার পরও অর্থ খরচ হয়, যার যার ভাগও চলে যায়, কিন্তু প্রকল্প শেষ হয় না। আমাদের জানানো হয় ‘বজ্র আঁটুনি’ কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি ‘ফসকা গেরো’। পাহারার খরচই কেবল বাড়ল, ফলাফল অনুল্লেখ্য কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার অধোপতনের চিহ্ন!
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নামে বিভিন্ন প্রকল্প যুক্ত থাকে। সড়ক, সেতু, ভবন নির্মাণ থেকে বিদ্যুৎ প্লান্ট পর্যন্ত সবই এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। দরপত্র বাছাই, নানা কমিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে এগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয়। বিদেশি ঋণ যদি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যদি এর অনুপাত ১০ ভাগও হয়, তাহলেও জটিলতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নানা কাগজপত্র তৈরির বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি থাকে, দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। বছরের পর বছর একই প্রকল্প বারবার আসে। সেতু অসমাপ্ত, রাস্তার খবর নেই, বাঁধ একটু হয়ে পড়ে আছে, ক্ষতিকর বাঁধে জলাবদ্ধতা স্থায়ী, হাসপাতালের ভবন একটু খাড়া কিন্তু যন্ত্রপাতি নেই, গ্যাসের লাইন শুরু কিন্তু শেষ নেই, গবেষণার ভবন আছে, গবেষণার বরাদ্দ নেই। নতুন নতুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা ও বিরাট বিরাট বরাদ্দ শুনে সবাই ভাবে, এবার বোধহয় উন্নয়নের নতুন একটি জোয়ার সৃষ্টি হবে, বরাদ্দ বেড়েছে, নতুন অনেক প্রকল্প মনে হয় যোগ হচ্ছে। কিন্তু জনগণের যা জানা হয় না তা হলো, নতুন বরাদ্দে বেশির ভাগ টাকা পুরোনো প্রকল্পের জন্যই গেছে। খরচের ফিরিস্তি বেড়েছে, সেগুলোর নতুন বাজেট পাস হয়েছে, নতুনভাবে তা যুক্ত হয়েছে নতুন বছরের বাজেটের সঙ্গে।
এ যেন সেই কুমির আর শিয়ালের গল্প। ‘পণ্ডিত’ শিয়ালের কাছে কুমির তার সাত বাচ্চাকে লেখাপড়া করতে দিয়ে গেল। মা কুমির প্রতিদিন একবার বাচ্চাদের খোঁজ নিয়ে যায়। প্রথম কিছুদিন সব ঠিকঠাক ছিল। তারপর ক্রমান্বয়ে একটি করে বাচ্চা শিয়ালের খাদ্য হতে থাকে। চতুর শিয়াল সব শেষ করে না, রেখে দেয় একটা। কুমির যখনই আসে, শিয়াল ওই একটি বাচ্চাই বারবার দেখায়, বলে, এই তোমার বাচ্চা। কুমিরও খুশিমনে ফিরে যায়। শিয়ালের কাজে সে খুবই খুশি। আমাদের দশা সেই বোকা, অমনোযোগী, বিশ্বাসী কুমিরের মতো। কোনো প্রশ্ন, পর্যালোচনা, সংশয় নেই, আছে বোকা বিশ্বাস; পরিসংখ্যানের হইচইয়ে মাথায় কোনো কিছুই কাজ করে না।
অনেকেই বলছেন বাস্তবায়নই হচ্ছে বাজেটের আসল সমস্যা। আসলেই কি তাই? অনুসন্ধানে দেখা যাবে বাস্তবায়নের সমস্যার অনেকখানি তৈরি হয় প্রকল্প নির্বাচন বা বাছাইয়ের মধ্যেই। ভুল, অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর প্রকল্পের ভিড়। কারণ দলীয় নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা দেশি-বিদেশি নানা গোষ্ঠীর ইচ্ছায় প্রকল্প নির্বাচিত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত আগে, বাছাইপ্রক্রিয়া পরে। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে বিরোধও হয়, হলে প্রকল্প বাছাই দীর্ঘায়িত হয়।
প্রকল্প নিয়ে এসব অভিজ্ঞতার পরও ২০১২-১৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ৫৫ হাজার কোটি টাকা, জনগণের সাধ্যমতো সবকিছু দেওয়ার পরও ৫২ হাজার কোটি টাকাই ঘাটতি। ঘাটতির প্রধান কারণ ঋণের সুদ। এই ঘাটতির জন্য আবার ঋণ হবে, দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে। আমরা এখন ঋণগ্রস্ততার দুষ্টচক্রের মধ্যে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী অর্থবছরে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাবেন। কোথায় কমবে? প্রশাসনের শানশওকত কমবে? গাড়ি কেনা কমবে? বিদেশ সফর কমবে? আউটসোর্সিংয়ের নামে প্রশাসনিক ব্যয়বৃদ্ধি কমবে? না, এগুলোর কোনোটাই কমবে না। ‘অপ্রয়োজনীয় খরচ’ কমানোর চেষ্টা আমরা আগের বাজেটগুলোতেও দেখি। যেসব কাজ জনগণের প্রয়োজন, সেগুলোই যেন অপ্রয়োজনীয় খরচ! টাকার অভাব দেখা যায় সর্বজনের (পাবলিক) শিক্ষা ও চিকিৎসার বিকাশে, দেখা যায় জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে, প্রয়োজনীয় শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠান বিকাশে, দেখা যায় গবেষণায়, দেখা যায় জনস্বার্থ রক্ষার জনবল বিকাশে।
২০১১-১২ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে ব্যয় হ্রাসের চিত্র দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এই সময় মূল বাজেট থেকে সংশোধিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে কমানো হয়েছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কমানো হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে কমানো হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সমগ্র বাজেট হিসাবে প্রশাসনের খরচ বেড়েছে ১০৬ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সমগ্র বাজেটের সম্পদের ব্যবহারের যে চিত্র বাজেট বক্তৃতায় উপস্থিত করা হয়েছে, তাতেও দেখা যায় সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে জনপ্রশাসনে (১২.৬%), এরপরই আছে ঋণের সুদ (১২.২%), তৃতীয় স্থানে আছে ‘বিবিধ ব্যয়’ (১১.৭%)!
জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিৎকার-বিতর্ক কম হয় না। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির অর্থ কী? জনগণের জীবনের গুণগত মান বৃদ্ধির পরিমাপ কই? পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি নষ্ট করে ইটখোলা বা চিংড়িঘের, জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন, নদী দখল করে বাণিজ্য, পাহাড় উজাড় করে ফার্নিচার, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে ক্রমান্বয়ে আরও বেশি বেশি বাণিজ্যিকীকরণ, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো—এর সবই জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। এগুলো আবার চোরাই টাকার আয়তনও বাড়ায়। দখলদারি অর্থনীতি, আতঙ্কের সমাজ, আর সন্ত্রাসের রাজনীতি—সবই পুষ্ট হয় উন্নয়নের এই ধারায়। সরকারকে যারা বছরে লক্ষ-কোটি টাকা দিয়ে পালেন, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তাহলে প্রাপ্তি কী?
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে যে কর-শুল্ক দেয় তা গত চার বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আদায়কৃত কর ও শুল্কের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। ২০১১-১২ পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অন্যান্য রাজস্ব মিলিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬৪ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা এবং এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। এই বছর কর রাজস্ব ২০ হাজার কোটি টাকাসহ অতিরিক্ত আরও ২৫ হাজার কোটি টাকার বোঝা জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে। তাতে ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হবে এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এটাও আদায় হবে, হয়তো বেশিই হবে।
তবে জনগণের বোঝা এখানেই শেষ হবে না। এবারও জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ভুল নীতি, ক্ষতিকর চুক্তি ও দুর্নীতির কারণে যে বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তার চাপ কমাতে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আয়োজন করা হচ্ছে। গত বছরের মতো এবারও তা করা হচ্ছে বাজেট ঘোষণার বাইরে। এগুলো নতুন কর-শুল্কের চেয়েও ব্যাপকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে। শিল্প, কৃষিসহ সব উৎপাদনশীল খাত আরও কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবে।
অথচ যাদের হাতে দেশের আয় ও সম্পদের বৃহদাংশ, তারা কিন্তু এখনো করজালের বাইরে। সরকারের সমীক্ষা ও অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিশাল অঙ্কের অর্থ সরকারের হিসাবে নেই। এটা হবে প্রায় পাঁচ লাখ থেকে সাত লাখ কোটি টাকা। এই আয়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপ্রদর্শিত আয়’, অর্থশাস্ত্রে এর আরেকটি নাম, ‘কালোটাকা’। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হতে পারে পরিশ্রমলব্ধ বৈধ আয়, কর না দেওয়ার কারণে তা এখন ‘অপ্রদর্শিত’ তালিকাভুক্ত। তবে এই টাকার বড় অংশের যথার্থ নাম হবে ‘চোরাই টাকা’, যা চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, ক্ষমতাপ্রয়োগ, জালিয়াতি, দখল ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে অর্জিত। এগুলোর মধ্যে আছে ঘুষ, নিয়োগবাণিজ্য, কমিশন, রাষ্ট্রীয় বা সর্বজন সম্পদ আত্মসাৎ, উর্দিপরা ও উর্দিছাড়াদের চাঁদাবাজি, কাজ না করে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ ভাগাভাগি, বাণিজ্যে ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিং ইত্যাদি। এসব কাজ ক্ষমতাবানদের পক্ষেই করা সম্ভব, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া এগুলো টিকতে পারে না।
এই বিশাল সম্পদ ও অর্থ করদানের আওতার বাইরে এবং তা অব্যাহতভাবে ক্রমবর্ধমান। গত কয়েক দশকে যে উন্নয়ন গতিধারা সরকার নির্বিশেষে পুষ্ট হচ্ছে এটা তারই ফল। অর্থমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে যখন বলেন, ‘এই উন্নয়ন গতিধারা অব্যাহত থাকবে’, তখন আতঙ্কিত হই। বুঝি সামনের বছর বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে, প্রকল্প-অপ্রকল্প ব্যয়ের মধ্য দিয়ে চোরাই টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে।
রাজস্ব আয়ের এই সম্ভাব্য বিশাল উৎস শুধু যে সরকারি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে তা নয়, এই অর্থ বিভিন্নভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়। এভাবে দেশি ও প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করা বিদেশি মুদ্রার মজুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খোরাক হচ্ছে চোরাই টাকার মালিকদের। তারপর এর ঘাটতি পূরণ করতে নেওয়া হচ্ছে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ।
প্রতিবছর বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, অনেক প্রকল্পের সমাবেশ। এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে এবারও অনেক প্রশ্ন উঠেছে। বাস্তবায়ন বলতে যদি টাকা খরচ বোঝায়, প্রতি বছরেই তা জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়, যদিও এপ্রিল মাস নাগাদ শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ খরচ হয়। খরচ সম্পন্ন হওয়া আর প্রকল্প সম্পন্ন হওয়া এক কথা নয়। খুব কম প্রকল্পই বাস্তবায়িত হচ্ছে, কিন্তু খরচ হয় পুরোটাই। এর ফলে পরের বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পূর্ণ হয় আগের বছরের অসমাপ্ত প্রকল্প দিয়ে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রথম বাজেট বক্তৃতায় এই অবস্থার পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিন বছর পর সর্বশেষ তিনি যে বাজেট উপহার দিলেন, সেখানে পরিস্থিতি একই রকম আছে। এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে শতকরা ৫০ ভাগের একটু বেশি। আমরা জানি, জুন পর্যন্ত সংশোধিত বাজেটের পুরোটা খরচ হবে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ এই বছরের কিংবা আরও পুরোনো অসমাপ্ত প্রকল্প। নতুনের সঙ্গে অনেকগুলো অসমাপ্ত প্রকল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে সামনের বছরের ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি’।
অথচ গত বেশ কয়েক বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থবরাদ্দ নিয়ে নানা নীতি, নিয়ম, প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ‘দাতা’ সংস্থাগুলোর ‘নজরদারি’র নানা শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে, সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশে-বিদেশে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এগুলোতেও বছর বছর বিদেশি ঋণসহ বরাদ্দ কম দেওয়া হয়নি। ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্স নামে বিদেশি ঋণ অনুদান, সেমিনার-ওয়ার্কশপ, বিদেশি কনসালট্যান্ট আনা, গাড়ি কেনা, বিদেশ সফর—সবই হয়েছে। এতসব প্রহরী, এতসব পরীক্ষা, তার পরও অর্থ খরচ হয়, যার যার ভাগও চলে যায়, কিন্তু প্রকল্প শেষ হয় না। আমাদের জানানো হয় ‘বজ্র আঁটুনি’ কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি ‘ফসকা গেরো’। পাহারার খরচই কেবল বাড়ল, ফলাফল অনুল্লেখ্য কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার অধোপতনের চিহ্ন!
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নামে বিভিন্ন প্রকল্প যুক্ত থাকে। সড়ক, সেতু, ভবন নির্মাণ থেকে বিদ্যুৎ প্লান্ট পর্যন্ত সবই এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। দরপত্র বাছাই, নানা কমিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে এগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয়। বিদেশি ঋণ যদি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যদি এর অনুপাত ১০ ভাগও হয়, তাহলেও জটিলতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নানা কাগজপত্র তৈরির বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি থাকে, দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। বছরের পর বছর একই প্রকল্প বারবার আসে। সেতু অসমাপ্ত, রাস্তার খবর নেই, বাঁধ একটু হয়ে পড়ে আছে, ক্ষতিকর বাঁধে জলাবদ্ধতা স্থায়ী, হাসপাতালের ভবন একটু খাড়া কিন্তু যন্ত্রপাতি নেই, গ্যাসের লাইন শুরু কিন্তু শেষ নেই, গবেষণার ভবন আছে, গবেষণার বরাদ্দ নেই। নতুন নতুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা ও বিরাট বিরাট বরাদ্দ শুনে সবাই ভাবে, এবার বোধহয় উন্নয়নের নতুন একটি জোয়ার সৃষ্টি হবে, বরাদ্দ বেড়েছে, নতুন অনেক প্রকল্প মনে হয় যোগ হচ্ছে। কিন্তু জনগণের যা জানা হয় না তা হলো, নতুন বরাদ্দে বেশির ভাগ টাকা পুরোনো প্রকল্পের জন্যই গেছে। খরচের ফিরিস্তি বেড়েছে, সেগুলোর নতুন বাজেট পাস হয়েছে, নতুনভাবে তা যুক্ত হয়েছে নতুন বছরের বাজেটের সঙ্গে।
এ যেন সেই কুমির আর শিয়ালের গল্প। ‘পণ্ডিত’ শিয়ালের কাছে কুমির তার সাত বাচ্চাকে লেখাপড়া করতে দিয়ে গেল। মা কুমির প্রতিদিন একবার বাচ্চাদের খোঁজ নিয়ে যায়। প্রথম কিছুদিন সব ঠিকঠাক ছিল। তারপর ক্রমান্বয়ে একটি করে বাচ্চা শিয়ালের খাদ্য হতে থাকে। চতুর শিয়াল সব শেষ করে না, রেখে দেয় একটা। কুমির যখনই আসে, শিয়াল ওই একটি বাচ্চাই বারবার দেখায়, বলে, এই তোমার বাচ্চা। কুমিরও খুশিমনে ফিরে যায়। শিয়ালের কাজে সে খুবই খুশি। আমাদের দশা সেই বোকা, অমনোযোগী, বিশ্বাসী কুমিরের মতো। কোনো প্রশ্ন, পর্যালোচনা, সংশয় নেই, আছে বোকা বিশ্বাস; পরিসংখ্যানের হইচইয়ে মাথায় কোনো কিছুই কাজ করে না।
অনেকেই বলছেন বাস্তবায়নই হচ্ছে বাজেটের আসল সমস্যা। আসলেই কি তাই? অনুসন্ধানে দেখা যাবে বাস্তবায়নের সমস্যার অনেকখানি তৈরি হয় প্রকল্প নির্বাচন বা বাছাইয়ের মধ্যেই। ভুল, অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর প্রকল্পের ভিড়। কারণ দলীয় নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা দেশি-বিদেশি নানা গোষ্ঠীর ইচ্ছায় প্রকল্প নির্বাচিত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত আগে, বাছাইপ্রক্রিয়া পরে। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে বিরোধও হয়, হলে প্রকল্প বাছাই দীর্ঘায়িত হয়।
প্রকল্প নিয়ে এসব অভিজ্ঞতার পরও ২০১২-১৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ৫৫ হাজার কোটি টাকা, জনগণের সাধ্যমতো সবকিছু দেওয়ার পরও ৫২ হাজার কোটি টাকাই ঘাটতি। ঘাটতির প্রধান কারণ ঋণের সুদ। এই ঘাটতির জন্য আবার ঋণ হবে, দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে। আমরা এখন ঋণগ্রস্ততার দুষ্টচক্রের মধ্যে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী অর্থবছরে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাবেন। কোথায় কমবে? প্রশাসনের শানশওকত কমবে? গাড়ি কেনা কমবে? বিদেশ সফর কমবে? আউটসোর্সিংয়ের নামে প্রশাসনিক ব্যয়বৃদ্ধি কমবে? না, এগুলোর কোনোটাই কমবে না। ‘অপ্রয়োজনীয় খরচ’ কমানোর চেষ্টা আমরা আগের বাজেটগুলোতেও দেখি। যেসব কাজ জনগণের প্রয়োজন, সেগুলোই যেন অপ্রয়োজনীয় খরচ! টাকার অভাব দেখা যায় সর্বজনের (পাবলিক) শিক্ষা ও চিকিৎসার বিকাশে, দেখা যায় জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে, প্রয়োজনীয় শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠান বিকাশে, দেখা যায় গবেষণায়, দেখা যায় জনস্বার্থ রক্ষার জনবল বিকাশে।
২০১১-১২ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে ব্যয় হ্রাসের চিত্র দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এই সময় মূল বাজেট থেকে সংশোধিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে কমানো হয়েছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কমানো হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে কমানো হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সমগ্র বাজেট হিসাবে প্রশাসনের খরচ বেড়েছে ১০৬ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সমগ্র বাজেটের সম্পদের ব্যবহারের যে চিত্র বাজেট বক্তৃতায় উপস্থিত করা হয়েছে, তাতেও দেখা যায় সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে জনপ্রশাসনে (১২.৬%), এরপরই আছে ঋণের সুদ (১২.২%), তৃতীয় স্থানে আছে ‘বিবিধ ব্যয়’ (১১.৭%)!
জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিৎকার-বিতর্ক কম হয় না। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির অর্থ কী? জনগণের জীবনের গুণগত মান বৃদ্ধির পরিমাপ কই? পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি নষ্ট করে ইটখোলা বা চিংড়িঘের, জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন, নদী দখল করে বাণিজ্য, পাহাড় উজাড় করে ফার্নিচার, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে ক্রমান্বয়ে আরও বেশি বেশি বাণিজ্যিকীকরণ, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো—এর সবই জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। এগুলো আবার চোরাই টাকার আয়তনও বাড়ায়। দখলদারি অর্থনীতি, আতঙ্কের সমাজ, আর সন্ত্রাসের রাজনীতি—সবই পুষ্ট হয় উন্নয়নের এই ধারায়। সরকারকে যারা বছরে লক্ষ-কোটি টাকা দিয়ে পালেন, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তাহলে প্রাপ্তি কী?
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।