পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

বাজেটের আরেক পাঠ


আনু মুহাম্মদ

বাজেটের প্রধান অংশ রাজস্ব আয় ও ব্যয়। সরকারের রাজস্ব আয় বলতে যা বোঝানো হয় তাকে আমরা অন্যদিক থেকে বলতে পারি কর, শুল্ক, ফিসহ নানাভাবে সরকারকে দেওয়া জনগণের অর্থ। আর রাজস্ব ব্যয় হলো, সরকারি প্রশাসন-প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ। সরকারি-আধাসরকারি পর্যায়ে সব ব্যয় জনগণের অর্থেই পরিচালিত হয়। 
বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে যে কর-শুল্ক দেয় তা গত চার বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আদায়কৃত কর ও শুল্কের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। ২০১১-১২ পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অন্যান্য রাজস্ব মিলিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬৪ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা এবং এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। এই বছর কর রাজস্ব ২০ হাজার কোটি টাকাসহ অতিরিক্ত আরও ২৫ হাজার কোটি টাকার বোঝা জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে। তাতে ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হবে এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এটাও আদায় হবে, হয়তো বেশিই হবে। 
তবে জনগণের বোঝা এখানেই শেষ হবে না। এবারও জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ভুল নীতি, ক্ষতিকর চুক্তি ও দুর্নীতির কারণে যে বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তার চাপ কমাতে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আয়োজন করা হচ্ছে। গত বছরের মতো এবারও তা করা হচ্ছে বাজেট ঘোষণার বাইরে। এগুলো নতুন কর-শুল্কের চেয়েও ব্যাপকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে। শিল্প, কৃষিসহ সব উৎপাদনশীল খাত আরও কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবে। 
অথচ যাদের হাতে দেশের আয় ও সম্পদের বৃহদাংশ, তারা কিন্তু এখনো করজালের বাইরে। সরকারের সমীক্ষা ও অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিশাল অঙ্কের অর্থ সরকারের হিসাবে নেই। এটা হবে প্রায় পাঁচ লাখ থেকে সাত লাখ কোটি টাকা। এই আয়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপ্রদর্শিত আয়’, অর্থশাস্ত্রে এর আরেকটি নাম, ‘কালোটাকা’। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হতে পারে পরিশ্রমলব্ধ বৈধ আয়, কর না দেওয়ার কারণে তা এখন ‘অপ্রদর্শিত’ তালিকাভুক্ত। তবে এই টাকার বড় অংশের যথার্থ নাম হবে ‘চোরাই টাকা’, যা চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, ক্ষমতাপ্রয়োগ, জালিয়াতি, দখল ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে অর্জিত। এগুলোর মধ্যে আছে ঘুষ, নিয়োগবাণিজ্য, কমিশন, রাষ্ট্রীয় বা সর্বজন সম্পদ আত্মসাৎ, উর্দিপরা ও উর্দিছাড়াদের চাঁদাবাজি, কাজ না করে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ ভাগাভাগি, বাণিজ্যে ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিং ইত্যাদি। এসব কাজ ক্ষমতাবানদের পক্ষেই করা সম্ভব, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া এগুলো টিকতে পারে না। 
এই বিশাল সম্পদ ও অর্থ করদানের আওতার বাইরে এবং তা অব্যাহতভাবে ক্রমবর্ধমান। গত কয়েক দশকে যে উন্নয়ন গতিধারা সরকার নির্বিশেষে পুষ্ট হচ্ছে এটা তারই ফল। অর্থমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে যখন বলেন, ‘এই উন্নয়ন গতিধারা অব্যাহত থাকবে’, তখন আতঙ্কিত হই। বুঝি সামনের বছর বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে, প্রকল্প-অপ্রকল্প ব্যয়ের মধ্য দিয়ে চোরাই টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে। 
রাজস্ব আয়ের এই সম্ভাব্য বিশাল উৎস শুধু যে সরকারি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে তা নয়, এই অর্থ বিভিন্নভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়। এভাবে দেশি ও প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করা বিদেশি মুদ্রার মজুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খোরাক হচ্ছে চোরাই টাকার মালিকদের। তারপর এর ঘাটতি পূরণ করতে নেওয়া হচ্ছে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ। 
প্রতিবছর বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, অনেক প্রকল্পের সমাবেশ। এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে এবারও অনেক প্রশ্ন উঠেছে। বাস্তবায়ন বলতে যদি টাকা খরচ বোঝায়, প্রতি বছরেই তা জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়, যদিও এপ্রিল মাস নাগাদ শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ খরচ হয়। খরচ সম্পন্ন হওয়া আর প্রকল্প সম্পন্ন হওয়া এক কথা নয়। খুব কম প্রকল্পই বাস্তবায়িত হচ্ছে, কিন্তু খরচ হয় পুরোটাই। এর ফলে পরের বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পূর্ণ হয় আগের বছরের অসমাপ্ত প্রকল্প দিয়ে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রথম বাজেট বক্তৃতায় এই অবস্থার পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিন বছর পর সর্বশেষ তিনি যে বাজেট উপহার দিলেন, সেখানে পরিস্থিতি একই রকম আছে। এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে শতকরা ৫০ ভাগের একটু বেশি। আমরা জানি, জুন পর্যন্ত সংশোধিত বাজেটের পুরোটা খরচ হবে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ এই বছরের কিংবা আরও পুরোনো অসমাপ্ত প্রকল্প। নতুনের সঙ্গে অনেকগুলো অসমাপ্ত প্রকল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে সামনের বছরের ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি’। 
অথচ গত বেশ কয়েক বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থবরাদ্দ নিয়ে নানা নীতি, নিয়ম, প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ‘দাতা’ সংস্থাগুলোর ‘নজরদারি’র নানা শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে, সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশে-বিদেশে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এগুলোতেও বছর বছর বিদেশি ঋণসহ বরাদ্দ কম দেওয়া হয়নি। ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্স নামে বিদেশি ঋণ অনুদান, সেমিনার-ওয়ার্কশপ, বিদেশি কনসালট্যান্ট আনা, গাড়ি কেনা, বিদেশ সফর—সবই হয়েছে। এতসব প্রহরী, এতসব পরীক্ষা, তার পরও অর্থ খরচ হয়, যার যার ভাগও চলে যায়, কিন্তু প্রকল্প শেষ হয় না। আমাদের জানানো হয় ‘বজ্র আঁটুনি’ কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি ‘ফসকা গেরো’। পাহারার খরচই কেবল বাড়ল, ফলাফল অনুল্লেখ্য কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার অধোপতনের চিহ্ন!
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নামে বিভিন্ন প্রকল্প যুক্ত থাকে। সড়ক, সেতু, ভবন নির্মাণ থেকে বিদ্যুৎ প্লান্ট পর্যন্ত সবই এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। দরপত্র বাছাই, নানা কমিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে এগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয়। বিদেশি ঋণ যদি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যদি এর অনুপাত ১০ ভাগও হয়, তাহলেও জটিলতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নানা কাগজপত্র তৈরির বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি থাকে, দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। বছরের পর বছর একই প্রকল্প বারবার আসে। সেতু অসমাপ্ত, রাস্তার খবর নেই, বাঁধ একটু হয়ে পড়ে আছে, ক্ষতিকর বাঁধে জলাবদ্ধতা স্থায়ী, হাসপাতালের ভবন একটু খাড়া কিন্তু যন্ত্রপাতি নেই, গ্যাসের লাইন শুরু কিন্তু শেষ নেই, গবেষণার ভবন আছে, গবেষণার বরাদ্দ নেই। নতুন নতুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা ও বিরাট বিরাট বরাদ্দ শুনে সবাই ভাবে, এবার বোধহয় উন্নয়নের নতুন একটি জোয়ার সৃষ্টি হবে, বরাদ্দ বেড়েছে, নতুন অনেক প্রকল্প মনে হয় যোগ হচ্ছে। কিন্তু জনগণের যা জানা হয় না তা হলো, নতুন বরাদ্দে বেশির ভাগ টাকা পুরোনো প্রকল্পের জন্যই গেছে। খরচের ফিরিস্তি বেড়েছে, সেগুলোর নতুন বাজেট পাস হয়েছে, নতুনভাবে তা যুক্ত হয়েছে নতুন বছরের বাজেটের সঙ্গে। 
এ যেন সেই কুমির আর শিয়ালের গল্প। ‘পণ্ডিত’ শিয়ালের কাছে কুমির তার সাত বাচ্চাকে লেখাপড়া করতে দিয়ে গেল। মা কুমির প্রতিদিন একবার বাচ্চাদের খোঁজ নিয়ে যায়। প্রথম কিছুদিন সব ঠিকঠাক ছিল। তারপর ক্রমান্বয়ে একটি করে বাচ্চা শিয়ালের খাদ্য হতে থাকে। চতুর শিয়াল সব শেষ করে না, রেখে দেয় একটা। কুমির যখনই আসে, শিয়াল ওই একটি বাচ্চাই বারবার দেখায়, বলে, এই তোমার বাচ্চা। কুমিরও খুশিমনে ফিরে যায়। শিয়ালের কাজে সে খুবই খুশি। আমাদের দশা সেই বোকা, অমনোযোগী, বিশ্বাসী কুমিরের মতো। কোনো প্রশ্ন, পর্যালোচনা, সংশয় নেই, আছে বোকা বিশ্বাস; পরিসংখ্যানের হইচইয়ে মাথায় কোনো কিছুই কাজ করে না।
অনেকেই বলছেন বাস্তবায়নই হচ্ছে বাজেটের আসল সমস্যা। আসলেই কি তাই? অনুসন্ধানে দেখা যাবে বাস্তবায়নের সমস্যার অনেকখানি তৈরি হয় প্রকল্প নির্বাচন বা বাছাইয়ের মধ্যেই। ভুল, অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর প্রকল্পের ভিড়। কারণ দলীয় নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা দেশি-বিদেশি নানা গোষ্ঠীর ইচ্ছায় প্রকল্প নির্বাচিত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত আগে, বাছাইপ্রক্রিয়া পরে। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে বিরোধও হয়, হলে প্রকল্প বাছাই দীর্ঘায়িত হয়। 
প্রকল্প নিয়ে এসব অভিজ্ঞতার পরও ২০১২-১৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ৫৫ হাজার কোটি টাকা, জনগণের সাধ্যমতো সবকিছু দেওয়ার পরও ৫২ হাজার কোটি টাকাই ঘাটতি। ঘাটতির প্রধান কারণ ঋণের সুদ। এই ঘাটতির জন্য আবার ঋণ হবে, দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে। আমরা এখন ঋণগ্রস্ততার দুষ্টচক্রের মধ্যে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী অর্থবছরে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাবেন। কোথায় কমবে? প্রশাসনের শানশওকত কমবে? গাড়ি কেনা কমবে? বিদেশ সফর কমবে? আউটসোর্সিংয়ের নামে প্রশাসনিক ব্যয়বৃদ্ধি কমবে? না, এগুলোর কোনোটাই কমবে না। ‘অপ্রয়োজনীয় খরচ’ কমানোর চেষ্টা আমরা আগের বাজেটগুলোতেও দেখি। যেসব কাজ জনগণের প্রয়োজন, সেগুলোই যেন অপ্রয়োজনীয় খরচ! টাকার অভাব দেখা যায় সর্বজনের (পাবলিক) শিক্ষা ও চিকিৎসার বিকাশে, দেখা যায় জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে, প্রয়োজনীয় শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠান বিকাশে, দেখা যায় গবেষণায়, দেখা যায় জনস্বার্থ রক্ষার জনবল বিকাশে। 
২০১১-১২ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে ব্যয় হ্রাসের চিত্র দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এই সময় মূল বাজেট থেকে সংশোধিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে কমানো হয়েছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কমানো হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে কমানো হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সমগ্র বাজেট হিসাবে প্রশাসনের খরচ বেড়েছে ১০৬ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সমগ্র বাজেটের সম্পদের ব্যবহারের যে চিত্র বাজেট বক্তৃতায় উপস্থিত করা হয়েছে, তাতেও দেখা যায় সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে জনপ্রশাসনে (১২.৬%), এরপরই আছে ঋণের সুদ (১২.২%), তৃতীয় স্থানে আছে ‘বিবিধ ব্যয়’ (১১.৭%)! 
জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিৎকার-বিতর্ক কম হয় না। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির অর্থ কী? জনগণের জীবনের গুণগত মান বৃদ্ধির পরিমাপ কই? পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি নষ্ট করে ইটখোলা বা চিংড়িঘের, জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন, নদী দখল করে বাণিজ্য, পাহাড় উজাড় করে ফার্নিচার, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে ক্রমান্বয়ে আরও বেশি বেশি বাণিজ্যিকীকরণ, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো—এর সবই জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। এগুলো আবার চোরাই টাকার আয়তনও বাড়ায়। দখলদারি অর্থনীতি, আতঙ্কের সমাজ, আর সন্ত্রাসের রাজনীতি—সবই পুষ্ট হয় উন্নয়নের এই ধারায়। সরকারকে যারা বছরে লক্ষ-কোটি টাকা দিয়ে পালেন, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তাহলে প্রাপ্তি কী? 
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

বাংলাদেশের কী হবে?


আতঙ্কের সমাজ, দখলদার অর্থনীতি, জমিদারি রাজনীতি এটাই বর্তমান সময়ের প্রধান পরিচয়। এর মধ্যেই আমরা ‘আছি’। বর্তমানে সারা দেশে দুর্নীতি দখলদারি, নানা অগণতান্ত্রিক আইনি-বেআইনি তৎপরতা, সন্ত্রাস-টেন্ডারবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্য ইত্যাদি বিস্তারের সুবিধাভোগী খুবই নগণ্য। যদি সামনে বিএনপি-জামায়াত বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় না থাকত তাহলে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে তাদের ক্ষোভেই সরকার টালমাটাল হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটাই আত্মরক্ষার প্রধান অবলম্বন। ক্ষুব্ধ সমর্থকদের ধরে রাখায় বিএনপি-জামায়াতের ভয়, যুদ্ধাপরাধীদের অস্তিত্ব তাদের প্রধান ভরসা। বিএনপি-জামায়াতও এই অস্ত্রই বরাবর কাজে লাগিয়েছে। আওয়ামী আমলের ভীতি প্রচার, কৃত্রিম ভারত-বিরোধিতা, ইসলাম ধর্ম বিপন্নতার প্রচারণা তাদের অনেক অপকর্ম জায়েজ করার প্রধান অবলম্বন। যারা এখন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পেছনে আছে তাদের অধিকাংশ অপছন্দ নিয়েই আছে, আছে অন্য দলের ভয়ে। অতএব জমিদারি রাজনীতির দুই ধারা পরস্পর পরস্পরের ভরসা, পরস্পর পরস্পরের জন্য অপরিহার্য। ঐক্য ও ধারাবাহিকতারও তাই কমতি নেই। 
যে কেউ সরকারের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের অন্যায় নিপীড়ন বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সরকারি দল বা কর্তাব্যক্তিদের একটা মোক্ষম ঢাল হলো এটা বলা যে, এটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। শিক্ষক, তৈরি পোশাক শ্রমিক, জমি সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা আন্দোলন—সবাইকে এই গালি শুনতে হয়। কিন্তু রামদা হাতে সরকারি পান্ডা, নিয়োগ-বাণিজ্যে নিয়োজিত এমপি, গুম খুনে সক্রিয় নানা বাহিনী, সরকারি হামলা নির্যাতন দখল, আর অদক্ষ বিচারপ্রক্রিয়া থাকতে কি আর কারও চক্রান্ত করার দরকার হবে? ৪০ বছর ধরে একাত্তরের দুর্বৃত্তদের বিচার আটকে আছে। জনগণের একটি বড় অংশ তারেক জিয়ার জমিদারি তাণ্ডব থেকে বাঁচার জন্য এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশায় আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। সরকারের ভূমিকা থেকে মনে হয় এই সরকার তারেক জিয়াকে মহানায়ক না বানিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের হাতে আত্মরক্ষার আরও পুঁজি সরবরাহ না করে ভুল নীতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দখলদারির যথেচ্ছাচার থেকে সরবে না। 
দম দেওয়া পুতুলের মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন। পরিস্থিতি, কাল বা প্রশ্ন কোনো কিছুই তাঁর গৎবাধা কথা বদলাতে পারে না। একের পর এক খুনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, খুনি ক্ষমা পায়, তিনি সব সময় বলতে থাকেন ‘অপরাধী যেই হোক তাকে অবশ্যই ধরা হবে।’ গুম খুন হাজার ছাড়িয়ে যায়; তিনি বলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো।’ ক্রসফায়ারে মৃত্যু হতে থাকে। রামদা হাতে সরকারি সংগঠনের কর্মীরা নানা জায়গায় সন্ত্রাস তৈরি করে, দখল চলে। আইনমন্ত্রী গড়গড় করে বলতেই থাকেন, ‘আইন সবার জন্য সমান।’ চাঁদাবাজি শুধু উর্দিছাড়া নয়, উর্দিপরা লোকজনও করতে থাকে। আইন-আদালত কী করে, তা নিয়ে তো কথা বলাই নিষেধ। প্রধানমন্ত্রী প্রায় সব সমস্যা সমাধানে নিজেই দায়িত্ব নেন। কিন্তু কোনো সমাধান দেখা যায় না। দিনবদলের কথা অর্থহীন। 
যাদের ২৪ ঘণ্টা রাষ্ট্রীয় অর্থে প্রতিপালিত নানা বাহিনীর পাহারায় কাটে তারা ছাড়া বাকি কারও তাই আতঙ্ক কাটে না। নিজের ও স্বজনের জীবন নিয়ে, পথের নিরাপত্তা নিয়ে, জিনিসপত্রের দাম, জীবিকা, ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা দিনরাত। সবচেয়ে বড় ভয়, দিনের পর দিন সবকিছুতে অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা এখন এমনই যে মানুষের জন্য মানুষের শোক, আতঙ্ক কিংবা উদ্বেগ নিয়েও একটু স্থির হয়ে বসা যায় না। নতুন আরেক আঘাত পুরোনো শোক বা আতঙ্ককে ছাড়িয়ে যায়। টিভি বা সংবাদপত্রেরও ঠাঁই নেই সবগুলোকে জায়গা দেওয়ার, কিংবা লেগে থাকার। 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই দলের সংঘাত কখনোই জমিদারি লড়াইয়ের চরিত্র থেকে বের হতে পারেনি। যে অংশ ক্ষমতায় থাকে তাদের ইচ্ছা হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেওয়ার। তাই একপর্যায়ে বিরোধ চরমে ওঠে। তখন মাঝেমধ্যে সম্রাটের দূতের মতো যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ এমনকি ভারতের প্রতিনিধিদের সাড়ম্বর আগমন ঘটে। সংঘাতে তাদের কর্তৃত্ব বাড়ে। দুই পক্ষ প্রতিযোগিতা করে ‘প্রভুর’ জন্য আরও বাড়তি সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার করে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চেষ্টা করে। আফ্রিকার দেশগুলোর মতো এ দেশে গোত্র বা এথনিক সংঘাতের অবস্থা নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি লড়াই যেন তার স্থানই পূরণ করতে যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংঘাত নিতে যাচ্ছে ট্রাইবাল সংঘাতের রূপ। সারা দেশ, সব প্রতিষ্ঠান এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছে। যারা লাভবান হচ্ছে তারা তালিও দিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে বা গোপনে।
দুই দলের ব্যানার দেখে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে না। দেখতে হবে ব্যানারের পেছনে দাঁড়ানো দখলদার কমিশনভোগীদের। দলের ব্যানার আসলে ব্যবহূত হয় তাদের মুখ ঢাকার জন্য। মানুষ দল দিয়ে বিচার করে, দলের ওপর ভরসা করে, দলের ওপর বিরক্ত হয়, ক্ষুব্ধ হয়, ক্ষোভে-দুঃখে চিৎকার করে। দল আসে যায়। কিন্তু কমিশনভোগী, দখলদারদের পরিবর্তন হয় না। তাদের শক্তি ও অবস্থান আরও জোরদার হয়। দুই দলের তীব্র সংঘাত চোখে পড়ে, আড়ালে দখল লুণ্ঠন কমিশনসহ নানা তৎপরতায় অংশীদারি ঠিকই চলে বহাল তবিয়তে। ব্যাংক, শেয়ারবাজার, মুদ্রা পাচার, মিডিয়াসহ নানা জায়গায় তার স্বাক্ষর আছে। 
সে জন্য গুম, খুন, ক্রসফায়ার, উর্দিপরা বা উর্দিছাড়া লোকজনদের ডাকাতি চাঁদাবাজি, কৃত্রিম কিংবা উসকে তোলা রাজনৈতিক উত্তেজনা, হরতাল, বিদ্যুতের সংকট—সবকিছু নিয়ে মানুষের অস্থিরতা, উদ্বেগ, অসুস্থতার মধ্যে ঠিকই অনেক কিছু হয়ে যেতে থাকে। শতকরা এক ভাগের হাতে আরও সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে কোনো বাধা নেই। পাহাড় নদী বন দখলকাজে কোনো সমস্যা নেই। দেশের সমুদ্র, সম্পদ, অর্থনীতিতে দেশি-বিদেশি লুটেরাদের আধিপত্য বৃদ্ধির আয়োজনে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। এগুলোতে দুপক্ষের বিরোধ নেই। 
এখানে দুই বন্ধু (বা শত্রুর) গল্প বলি। এরা হতে পারে দুজন আমলা, দুজন ঠিকাদার, দুজন কনসালট্যান্ট, দুজন মন্ত্রী এমনকি হতে পারে দুই সময়ের দুই সরকার। গল্পের শুরুর কালে বন্ধু ‘ক’ ও ‘খ’-এর সীমিত আয়, স্বাভাবিক জীবনযাপন। এর মধ্যে একদিন ‘ক’ ‘খ’-এর বাড়িতে গিয়ে হতবাক। ঘরবাড়িতে নতুন বিত্তের চিহ্ন। ‘কোথায় পেলে তুমি এসব?’ বারবার প্রশ্ন করায় একপর্যায়ে ‘খ’ ‘ক’ কে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে বলে। বাইরে একটা সড়ক ছাড়া আর কিছু নেই। ‘খ’ বলে ‘এটাই’। দিন মাস বছর যায়। ‘খ’ যায় ‘ক’-এর বাড়িতে। ‘ক’-এর বাড়ির জাকজমক তার চেয়েও বেশি। ‘কীভাবে এত টাকা বানানো সম্ভব?’ ‘ক’ এবার হাসিমুখে ‘খ’-কে জানালা দিয়ে তাকাতে বলে। একটা সেতু, দুপাশে ভাঙা, আধাখেচড়া পড়ে আছে। ‘খ’ বুঝতে পারে। আবার দিন মাস বছর যায়। ‘ক’ যায় ‘খ’-এর বাড়িতে, এখন সেটা অট্টালিকা। বিত্তের আওয়াজ বেড়েছে অনেক গুণ। ‘ক’-এর মাথায় প্রশ্ন। ‘এত টাকা কীভাবে সম্ভব?’ ‘খ’ আবার জানালা দিয়ে তাকাতে বলে। বাইরে কোনো কিছু নেই। শুধু মাঠ। ‘ক’ প্রথমে বুঝতে পারে না। ‘খ’ বলে, ‘এই তো’। প্রথমে কাজ করে লাভ, পরে কিছু কাজ করে পুরো টাকা। পরে কিছুই না করে পুরোটাই মেরে দেওয়া।
সেটাই তো হওয়ার কথা। প্রক্রিয়া যদি একই থাকে ক্ষুধা দিন দিন বাড়তে থাকে। পেট তো ভরতে হবে। তাই এভাবে চলতে চলতে মাঠ, গাছ, বন, জঙ্গল, পাহাড়, নদী, নালা, খালবিল সব হজম হতে থাকে। ‘ক’ আর ‘খ’-এর যখন যার সুযোগ আসে। কখনো প্রতিযোগিতা কখনো সহযোগিতা। কখনো ঐক্য কখনো সংঘাত। দখল, কমিশনের ওপর দাঁড়ানো বিত্ত-বৈভব শানশওকতে শহরের কিছু কিছু স্থান ঝলমল করতে থাকে। অনেকে স্মরণ করতে পারেন সেলিম আল দীনের মুনতাসির ফ্যান্টাসি নাটক। সবকিছুই প্রধান চরিত্র মুনতাসিরের খাদ্য। তার ক্ষুধার কোনো শেষ নেই। আমাদের দেশে একের পর এক শাসকগোষ্ঠী একজনের থেকে অন্যজন আরও বেশি মুনতাসির। ক্ষমতাবানেরা যখন এভাবে নিজের অর্থনীতি তৈরি করেন তখন রাজনীতি কেন জমিদারি থেকে আলাদা হবে? আমাদেরই বা সদা আতঙ্ক ছাড়া আর কী পাওয়ার আছে?
দেশি-বিদেশি দখলদারদের জন্য দুই দলের পালাবদল খুবই সুবিধাজনক। এই নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে, সমাজে এই চিন্তা টিকিয়ে রাখতে কারও কারও সক্রিয়তা আছে। এই অবস্থায় তাহলে কী হবে বাংলাদেশের? পরিবারতন্ত্রের আড়ালে, চোরাই টাকার মালিক সন্ত্রাসী প্রতারক দখলদার কমিশনভোগীদের হাতে, নিজেদের সর্বনাশ দেখতেই থাকবে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ? তাহলে কি আর উপায় নেই? শক্তিশালী মিডিয়া ও সুশীল সমাজের দরবারে এই বলয়ের বাইরে আলোচনারও সুযোগ কম। ভিন্ন স্বর ভিন্ন সত্য ভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে মানুষের চিন্তার সুযোগও তাই তৈরি হয় না। ফলে জনগণের মধ্যে এক অসহায়ত্বের বোধ এখন প্রায় স্থায়ীরূপ নিয়েছে। 
কিন্তু এই দুই ধারার একটির বদলে অন্যটি আমাদের বর্তমান অবস্থার যে কোনো সমাধানই দেবে না তা বোঝার জন্য আর কত পালাবদল দরকার? আর কত ক্ষয় আর কত সর্বনাশ দেখতে হবে আমাদের? এই জমিদারি সংঘাত ও ঐক্য কোথায় নিয়ে যাবে দেশকে, ক্ষমতা তাদেরও হাতে থাকবে কি না, দেশি-বিদেশি কারা অপেক্ষমাণ—সবকিছুই এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তা। এই বিষচক্র থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসন যে সমাধান নয় তার প্রমাণ বারবার হয়েছে। বরং এতে এই প্রক্রিয়ারই আরও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। আর দুজনের সংলাপ ও ঐক্য? তাতে এই ধারাবাহিকতা ও জনগণের অবস্থার পরিবর্তনের তো কিছু নেই।
সে কারণেই যুদ্ধাপরাধী ও লুটেরা শক্তির, দখলদার ও জমিদারদের রাজনৈতিক মতাদর্শিক প্রভাব অতিক্রম করে জনগণের রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ছাড়া উপায় দেখি না। নিষ্ক্রিয়, আচ্ছন্ন আর সন্ত্রস্ত জনগণের মধ্যে ক্ষমতার বোধ বিকশিত হওয়া ছাড়া এটা সম্ভব নয়। দখলদারদের দাপটে বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখাই এখন অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতার জালের আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হলে, নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে সক্ষম হলে, জনগণ তার অন্তর্গত বিশাল শক্তিও অনুভব করতে সক্ষম হবে, সক্ষম হবে স্বাধীন পথ গ্রহণ করতে। মানুষ যদি নিজে মুক্ত না হয়, তার মুক্তির কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয় না। 
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

সমুদ্রসীমা রায়: স্বস্তি ও উদ্বেগ


anu-f1111সমুদ্র সাধারণভাবে বিশ্বের সকল মানুষের সম্পদ। কিন্তু এই বিশ্বের সকল মানুষের এই সাধারণ সম্পদ সাম্রাজ্যবাদী কিছু রাষ্ট্র আর বহুজাতিক সংস্থার মুনাফা আর দখল তৎপরতায় ক্ষতবিক্ষত, দূষিত, বিপর্যস্ত। যে সমুদ্র অপরিমেয় সম্পদের ক্ষেত্র তা বর্তমান আগ্রাসী দখলদার বিশ্বব্যবস্থায় যুদ্ধ, ভয়ংকর গবেষণা এবং মুনাফামুখি নানা তৎপরতায় মানুষের কর্তৃত্বের বাইরে। সবল কতিপয় রাষ্ট্র ও সবল ক্ষুদ্র মুনাফাভোগী শ্রেণীর আধিপত্য এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই আগ্রাসী পরিস্থিতির মধ্যে দুর্বল দেশগুলোর জনগণকে সতর্ক থাকতে হয়, অবস্থান নিশ্চিত রাখবার জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনের আশ্রয় নেবার জন্য দক্ষ প্রস্তুতি রাখতে হয়। আর এসব দেশের সরকার যদি জনগণের স্বার্থ প্রতিনিধিত্ব না করে তাহলে জনগণের দিক থেকে সতর্কতা বাড়াতে হয় আরও বহুগুণ।
১৯৮২ সালের জাতিসংঘ সমুদ্র কনভেনশন আইন অনুযায়ী, যেকোন দেশ সমুদ্রের ভেতর ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত নিজ সীমা হিসেবে দাবী করতে পারে। এর মধ্যে ১২ মাইল সার্বভৌম সীমার অন্তর্ভূক্ত এবং পরবর্তী ১৮৮ মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। সম্প্রসারিত হিসেবে সমুদ্র ভূমিতে একটি দেশ ৩৫০ মাইল পর্যন্ত নিজেদের কর্তৃত্বাধীন বিবেচনা করতে পারে।
কিন্তু ২০০৮ সালে এসে আমরা জানতে পারি যে, সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মায়ানমার তাদের দাবি জাতিসংঘে উপস্থিত করেছে এবং তাতে বঙ্গোপসাগরে প্রাপ্য সমুদ্রসীমার দুইতৃতীয়াংশ বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্থলভাগের প্রায় দুইগুণ সমপরিমাণ সামুদ্রিক অঞ্চল চলে যাচ্ছে মায়ানমার ও ভারতের হাতে।
২০০১ সালে জাতিসংঘ কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এর ১০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১১ সালের মধ্যে সমুদ্রসীমায় আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য সব প্রমাণাদি ও কাগজপত্র জমা দেবার কথা। ২০০৪ সালে পেট্রোবাংলা, জিএসবি, নেভি, স্পারসো, আইডব্লিউটিএ, সার্ভেয়ার অব বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল বলে আমরা জেনেছি, কিন্তু সেটি কোন কাজ করেনি। এরকম অবস্থাতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সমুদ্র অঞ্চলকে ২৮টি ব্লকে (৮টি অগভীর ও ২০টি গভীর সমুদ্রে) ভাগ করে তৃতীয় দফা বিডিংএর সিদ্ধান্ত নেয় এবং তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করে। বহুজাতিক কোম্পানির সাথে উৎপাদন অংশীদারী চুক্তি (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট বা পিএসসি) করবার ব্যাপারে সরকারের বিপুল আগ্রহ দেখা গেলেও সমুদ্রসীমা নিয়ে এই বিপদ সম্পকে এই সরকারের কোনো সক্রিয়তা দেখা যায়নি।
পরিস্থিতি তখন এমন যে, মায়ানমার ও ভারতের দাবি আন্তর্জাতিক ফোরামে স্বীকৃত হলে বাংলাদেশ শুধু বিশাল অঞ্চল হারাবে তাই নয়, জানা অজানা সম্পদের এমন ভান্ডার তার হাতছাড়া হবে যা বহুকালের বহু প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশকে পাল্টে দিতে সক্ষম। তাছাড়া সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি তো আছেই। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগের আরও কারণ ছিল এটাই যে, ভারত ও মায়ানমার তাদের নথিপত্র জমা দিলেও বাংলাদেশের সেসময় পর্যন্ত কোনো প্রস্তুতিও ছিল না। শেষ সময়সীমা ২০১১ সাল, কিন্তু সমুদ্রসীমা নিয়ে দাবি উত্থাপন করতে গেলে সমুদ্রে জরীপসহ অনেক কাজ বাকি, কিছুই হয়নি তখনো।
তখন থেকেই আমরা ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র পক্ষ থেকে সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রসম্পদ বিষয়ে কথা বলা শুরু করি। একইবছর বিশেষজ্ঞ ও উদ্বিগ্ন ব্যক্তিদের নিয়ে ‘সমুদ্র অঞ্চল ও সীমানা রক্ষা জাতীয় কমিটি’গঠিত হয়।গবেষক নূর মোহাম্মদ আহবায়ক ও রিয়ার এডমিরাল (অব:) খুর্শেদ আলম এর সদস্য সচিব ছিলেন। এই কমিটি বিভিন্ন সেমিনার প্রকাশনার মধ্য দিয়ে দেশের জনগণের মধ্যে সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রসম্পদ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। খুর্শেদ আলম এই বিষয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন।বস্তুত তিনিসহ আরও সীমিত কয়েকজন ব্যক্তির গবেষণা লেখালেখি বিশ্লেষণ থেকেই আমরা এই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা পাই এবং তা জনগণের মধ্যে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি। ২০০৯ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবার পর খুর্শেদ আলমকে অতিরিক্ত সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে সমুদ্র ডেস্কের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।এটা ছিল সরকারের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত।সুযোগ পেলে বাংলাদেশের মানুষ যে কাজ করতে পারেন তা এখানে প্রমাণিত হয়েছে।
২০০৮ সালে ক্ষমতার নানা কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের পক্ষে সমুদ্র জরিপ করা সম্ভব নয়। এর জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞ লাগবে, বিশ্বব্যাংকের ঋণ লাগবে, বিপুল অর্থ দরকার, বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ খুর্শেদ আলমের নেতৃত্বে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রয়োজনীয় জরীপ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়, যা মায়ানমারের সাথে মোকাবিলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আন্তর্জাতিক আদালতে মায়ানমারকে মোকাবিলা করতে গিয়ে সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশ যে দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে তার স্থায়ী গুরুত্ব আছে। নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়াও সামনে ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতেও এগুলো কাজে লাগবে। ভারতের সাথে এখনও আমাদের সমস্যার নিষ্পত্তি হয়নি। ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার কথা বলছেন কেউ কেউ। সেটা খুবই বিপজ্জনক প্রস্তাব। কারণ, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার অভিজ্ঞতা আমাদের মোটেই ভালো নয়। ভারত সবসময়ই আন্তর্জাতিক বিষয় দ্বিপক্ষীয়ভাবে সারতে চায়। কিন্তু তাতে কোনোক্ষেত্রেই বাংলাদেশের লাভ হয়নি, বরং ক্ষতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরাম ও আইনি ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনোভাবে ভারতের সঙ্গে সমাধান হবে না। মামলার রায়ের মধ্য দিয়েই উভয় পক্ষ নিজ অঞ্চল ও সীমানা নির্ধারন করতে পারবে। তবে এর জন্য আরও সতর্ক ও দক্ষ প্রস্তুতি লাগবে। বাংলাদেশের সরকার তার ভূমিকা পালনে আন্তরিক হলে, শৈথিল্য না দেখালে বা ভারতের প্রতি বিশেষ ছাড় দেবার কোন প্রবণতা না থাকলে ভারতের সাথে আমাদের বিজয় অর্জন খুবই সম্ভব।
ভারতসহ আরও বেশকিছু বিষয় এখনও মীমাংসা বাকি থাকলেও ১৪ মার্চের রায়ের মাধ্যমে সমুদ্রের একটি নির্দিষ্ট সীমার ওপর আমাদের আইনি অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এটা আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই আইনী অধিকার কার্যকর অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা হবে কিনা সেটা নিয়েই এখন সংশয় তৈরি হয়েছে।
সমুদ্রসীমা নিয়ে এই রায়ের পরপরই সরকার ও সরকার বহির্ভূত কোম্পানিমুখি বিভিন্ন লোকজন যেভাবে বিদেশি কোম্পানিকে ব্লক ইজারা দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ ও উচ্ছাস দেখাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে এই বিজয় বহুজাতিক কোম্পানির, বাংলাদেশের জনগণের নয়। কিন্তু সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশের মালিকানা মানে এখানকার জাতীয় সম্পদের ওপর জনগণের শতভাগ মালিকানা। সম্পদের শতভাগ নিজেদের কাজে ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত না হলে এই বিজয় অর্থহীন।
সমুদ্রসীমা নিয়ে মায়ানমারের সাথে নিষ্পত্তি হবার পর কনোকোফিলিপসকে সমুদ্রের আরও ছয়টি ব্লক দেবার ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। গত বছরের ১৬ জুন সরকার এই মার্কিন কোম্পানির সাথে যে চুক্তি করে, তা বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি বরং বাংলাদেশকে বিভিন্ন দিক থেকে বড় বিপদের মুখে নিক্ষেপ করেছে। দক্ষতার যুক্তি দিয়ে দুর্ঘটনার রাজা কনোকোফিলিপসকে ১০ ও ১১ ব্লক তুলে দিলেও এই কোম্পানি এখন চীনা একটি কোম্পানিকে সাবকন্ট্রাক্ট দিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রব্লকে কাজ করাচ্ছে। যে রফতানিমুখি চুক্তির ভিত্তিতে এই কোম্পানি আমাদের সমুদ্রের ব্লকগুলো ইজারা নিয়েছে, এরকম শর্তে আরও ব্লক ইজারা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি শকুনের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কোম্পানিমুখি প্রচারকেরা এই চুক্তির পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে সবসময় বাংলাদেশের অক্ষমতার কথাই বলেন, হীনম্মন্যতাই তাদের প্রধান অবলম্বন। অথচ সমুদ্রের জানা অজানা সম্পদের ওপর যাতে জাতীয় মালিকানা ও জনগণের যথাযথ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় জাতীয় সক্ষমতার বিকাশের কোন উদ্যোগ নেবার কথা তাদের মুখে কখনো শোনা যায়না। তাদের কথা অনুযায়ী চললে বাংলাদেশের হীনদশা কখনো কাটবে না।
আরও একটি উদ্বেগের বিষয় হলো, বঙ্গোপসাগরের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের মনোযোগ আরও বেড়েছে । তারা আমাদেরকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করতে চায়, আমাদের নিরাপত্তা দিতে চায়! কিন্তু আমরা জানি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর যেখানেই গেছে, সেখানে হত্যা, লুটপাট, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছু আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র যদি বলে নিরাপত্তা তাহলে আসে সহিংসতা, যদি বলে শান্তি আসে ধ্বংস, যদি বলে গণতন্ত্র আসে স্বৈরতন্ত্র।বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তার নামে তাদের কর্তৃত্ব বিস্তারের চেষ্টা কিংবা এই কর্তৃত্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীন ভারত ঐক্য কিংবা সংঘাত সবগুলোই বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।আমরা জানি যে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ‘অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুভাবেই দক্ষিণ এশিয়া এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে। ২০০৮ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর ইরাক থেকে সরে দক্ষিণ এশিয়ায় মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। এই অঞ্চলে ভারত, চীন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নানা মাত্রায় ঐক্য ও সমঝোতার প্রধান বিষয় হল, জ্বালানী খনিজ সম্পদ, ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আর সেইসঙ্গে এগুলোর আমদানি রফতানির জন্য তেল ও গ্যাস পাইপলাইন, বন্দরের উপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা’। (The Militarization of India, http://www.counterpunch.org/2011/05/27/the-militarization-of-india/)
সমুদ্র সীমায় যদি বিদেশি সৈন্য মোতায়েন হয় কিংবা যদি সমুদ্রের বিশাল সম্পদের মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হয়, যদি এই সম্পদ রফতানিমুখি চুক্তির আড়ালে বিদেশে পাচার হয় তাহলে অর্জিত এই সার্বভৌম অধিকার প্রহসন ছাড়া আর কী হবে? কারণ, বাংলাদেশে তো বটেই বহুদেশে এরকম অভিজ্ঞতা আছে যে, সম্পদ পেলেই জনগণ সেই সম্পদের ব্যবহার করতে পারবে তা নয়, সম্পদ পেলেই তার ওপর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তা নয়। সরকার যদি জনগণের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ না করে তাহলে সম্পদ বরং পরিণত হতে পারে অভিশাপে। আমরা জানি সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা কিন্তু এদেশের বিভিন্ন সরকার সাম্রাজ্যবাদের কিংবা কমিশনভোগী দেশি লুটেরাদের স্বার্থরক্ষার্থেই তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ভয়টা সেখানেই।
আগে জাতীয় মনোযোগে না থাকলেও এটা এখন সবাই স্বীকার করবেন যে, বাংলাদেশ শুধু নদীমাতৃক দেশ নয়, সমুদ্রমাতৃকও। অতএব সমুদ্রের ওপর কর্তৃত্ব এবং এর সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করবার জন্য এর সাথে অসঙ্গতিপূণ চুক্তি বাতিলের পাশাপাশি জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে বিস্তৃত পরিকল্পনা নেয়াই এখন প্রধান করণীয়। এই লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা দরকার। বড় দায়িত্ব নেবার মতো করে পেট্রোবাংলাকে সাজানো দরকার। প্রয়োজনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের এই কাজে যুক্ত করা খুবই সম্ভব। সরকার যদি এর উল্টো পথে চলে, তাহলে জনগণকেই তার নিজের সম্পদ বুঝে নিতে ও সার্বভৌম অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ।

বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

বিশ্ব অর্থনীতিঃ বিদ্রোহের নতুন পরিচয়: ‘আমরা ৯৯%’



আনু মুহাম্মদ | তারিখ: ২০-১০-২০১১
‘আমরা ৯৯%’ এই পরিচয় নিয়ে এবং দখল করার ডাক দিয়ে নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, শ্রমিক, লেখক-শিল্পী, বেকার, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত এবং সংবেদনশীল নিপীড়ন-বৈষম্য অন্যায়বিরোধী মানুষের বিক্ষোভ ক্রমেই দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। সমাবেশে উপস্থিতি শত ছাড়িয়ে হাজার, হাজার ছাড়িয়ে লাখ অতিক্রম করছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় এক হাজার শহরে এই বিক্ষোভ-সমাবেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। কোথাও কোথাও পুলিশ বাধা দেওয়ায় তার সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়েছে। রক্তাক্ত হয়েছে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ মানুষ। কয়েক দিন আগে বিক্ষোভকারীরা একটি ছোট্ট ভিডিওতে প্রকাশ করেছে, ওবামা ও হিলারি যখন সিরিয়া, লিবিয়া বা মিসরকে উপদেশ দিচ্ছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় দমন-পীড়ন বন্ধ করতে, যখন তরুণ প্রজন্মকে নতুন ইতিহাস নির্মাণে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, তখন তাদেরই পুলিশ যুক্তরাষ্ট্রের শহরে শহরে নিরস্ত্র বিদ্রোহী তরুণদের ওপর বর্বর হামলা পরিচালনা করছে (http://front.moveon.org/the-most-powerful-occupywallstreet-clip-you-will-see-this-month/) | তরুণ বিক্ষোভকারীরা প্রত্যয়ী, তাদের সংখ্যা ও দৃঢ়তা বাড়ছেই। 
কারা এই বিক্ষোভের লক্ষ্য? কারা এর প্রতিপক্ষ? আর কারা এই আন্দোলনের পক্ষে? এই আন্দোলনের গতিমুখ কোন দিকে? কেন এই দুটি স্লোগানের সঙ্গে সবাই নিজের আকাঙ্ক্ষা মেলাতে পারছে? ‘আমরা ৯৯%’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে সর্বত্র শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের জীবন ও স্বার্থের ঐক্য-সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে। এটি আরও স্পষ্ট হয় যখন বিক্ষোভকারীরা বলে, ‘শতকরা ১ ভাগ আমাদের সম্পদ দখল করে রেখেছে।’ মাইকেল প্যারেন্টি বলছেন, ‘এটি সরাসরি শ্রেণীযুদ্ধের আওয়াজ।’ সেই এক ভাগের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ একচেটিয়া পুঁজির প্রতিনিধি বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা, ব্যাংক, বিমা এবং নানা অর্থকরী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদেরই কেন্দ্র নিউইয়র্কের বাণিজ্যিক এলাকা ওয়াল স্ট্রিট। এক পোস্টারে এর নাম দেওয়া হয়েছে, ওয়ার স্ট্রিট। কেননা, এদের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র দেশের পর দেশ দখল ও সন্ত্রাসে তার সর্বশক্তি নিয়োজিত রেখেছে গত ছয় দশক। আরেক পোস্টারে লেখা, ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, নট আফগানিস্তান’। 
এক পোস্টারে বলা আছে ‘ওয়াল স্টিট গ্রিড=হাংরি কিডস’। ১%-এর লোভের জন্যই সারা বিশ্বে অনাহার, দারিদ্র্য, অকালমৃত্যু—যাদের বড় অংশ শিশু। সারা বিশ্বের সর্বজনের সম্পদ উন্নয়নের নামে গ্রাস করেছে কতিপয় গোষ্ঠী কিংবা করপোরেশন। তাদের মুনাফার লোভ মেটাতে গিয়ে অনিশ্চয়তা, সন্ত্রাস, অপমানে জর্জরিত শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ কেন অনাহারে এবং চিকিৎসার অভাবে বিপর্যস্ত হবে? কেন আশ্রয়হীন থাকবে? এটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হওয়ার কথা। কেননা, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, নিজ দেশ শুধু নয় সারা বিশ্বের বিশাল সম্পদ কতিপয় মার্কিন গোষ্ঠী আর তাদের শাগরেদদের দখলে। একটি ছোট ঘোষণা ভিডিওতে প্রথম কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় ১৪ জুন (http://www.globalresearch.ca/index.php?context=va&aid=26864)। বলা হয় ‘ডেমোক্র্যাটরা ব্যর্থ, রিপাবলিকানরা ব্যর্থ। এখন আমাদের স্বার্থ আমাদেরই দেখতে হবে, তোমার স্বার্থ তোমাকেই দেখতে হবে।’ আরও বলা হচ্ছে, ‘যারা পরিকল্পিতভাবে আমাদের সম্পদ লুট করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়েছে তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। ‘আমরা ৯৯%।’ কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘অপারেশন এম্পায়ার স্টেট’।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন এই হাল? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সরে যায়। তার পর থেকে আধিপত্য বিস্তার এবং তেল কোম্পানি, অস্ত্র কোম্পানিসহ বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ, সহিংসতা, সামরিক শাসন, গণহত্যা বিস্তৃত করেছে। নোয়াম চমস্কি, জোসেফ স্টিগলিজ, নাওমি ক্লেইন, উইলিয়াম ব্লুমসহ অনেকেই তথ্য-উপাত্ত দলিল দিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী শক্তি। কোনো দেশ পারমাণবিক গবেষণা করলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নানা প্রতিরোধ তৈরি করে কিন্তু নিজের পারমাণবিক স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই তাকে প্রতিবছর খরচ করতে হয় বিশাল অর্থ। 
এক হিসাবে দেখা গেছে, শুধু এই কাজে যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থ ব্যয় হয় তা যদি এক ডলারের নোট দিয়ে দড়ি বানানো হয় তাহলে তার দৈর্ঘ্য এমন হবে যে, সেই দড়ি দিয়ে চাঁদে গিয়ে ফেরত আসা যাবে। যখন যুক্তরাষ্ট্রে কখনো না কখনো অনাহারে থাকেন এমন মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি, বেকার শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ, যখন শিক্ষা-চিকিৎসার অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না, তখন যুদ্ধ, গোয়েন্দাগিরি, চক্রান্ত ইত্যাদি কাজে এই একই রাষ্ট্রের বার্ষিক খরচ এক হাজার বিলিয়ন ডলার বা এক ট্রিলিয়ন ডলার। অনাহারী মানুষের খাদ্য জোগানের খরচ মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার!
কৃত্রিম জৌলুশ, বিশ্বব্যাপী দখল সন্ত্রাস ও একচেটিয়া পুঁজিকে সম্পদ জোগাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ। বার্ষিক জাতীয় আয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তার ঋণ। রাষ্ট্র, পরিবার এবং ব্যক্তি—সবই এখন ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। রাষ্ট্রীয় ঋণের সীমা যখন অতিক্রম করতে যাচ্ছে, তখন গত মাসে, কংগ্রেসে ঋণসীমা বৃদ্ধির অনুমতি নিয়েছে ওবামা সরকার। গৃহঋণ ধস থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে পরিবারের পর্যায়ে আয়ের তুলনায় ঋণ এত বেশি যে তা শোধ করার সীমা তারা পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই জায়গায় এসে ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ধসে পড়ে। আবার বেইলআউটের নামে জনগণের করের টাকায় ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয় তাদের উদ্ধারের জন্য। যাদের জন্য মানুষ ও অর্থনীতির দৈন্য তাদের শাস্তি না দিয়ে, হাতে আরও টাকা তুলে দেওয়া হয় ‘চুইয়ে পড়া তত্ত্ব’ অনুযায়ী; যে তত্ত্ব বলে ধনীদের হাতে যত টাকা যাবে তত তারা বিনিয়োগ করবে, তত কর্মসংস্থান বাড়বে। বাড়েনি, বেকারত্ব বেড়েছে। কারণ, সম্পদ কেন্দ্রীভূত যাদের হাতে, অধিক মুনাফার জন্য তারা এমন বিনিয়োগে আগ্রহী যাতে উৎপাদনশীল তৎপরতা বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাজ আয় এমনকি খাদ্য যখন অনিশ্চিত তখন বড় বড় করপোরেশনের, যাদের জালিয়াতির জন্য অর্থনীতির ধস, কর্মকর্তারা বেইলআউটের টাকায় আয় করেছে কোটি ডলার বোনাস, বেতন।
এই ছবি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের। যুক্তরাষ্ট্র যাদের সম্পদ দিয়ে একটা কৃত্রিম সচ্ছলতার ঘোর তৈরি করে মার্কিনদের বহুদিন বুঁদ করে রাখতে পেরেছিল, সেই সব প্রান্তস্থ দেশে লড়াই বহুভাবে বহুদিন ধরেই চলছে। সেই লড়াই দমনে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামরিক জোগানদার ছিল যুক্তরাষ্ট্রই। এখন কেন্দ্র প্রত্যক্ষ করছে বিদ্রোহ। এখন শোষণ-নিপীড়নের বিশ্বায়নের মোকাবিলা করতে জোরদার হচ্ছে প্রতিরোধের বিশ্বায়নের ঐতিহাসিক পর্ব। 
আন্দোলনের সক্রিয় অংশীদার আমেরিকান ওয়ার্কার্স কোঅপারেটিভের প্রেসিডেন্ট বন্ধু ডিজার হর্ন ১৮ অক্টোবর ই-মেইলে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে কেউ পুঁজিবাদ শব্দটি উচ্চারণ করলেই তাঁকে কমিউনিস্ট গালি খেতে হতো। এখন পুঁজিবাদের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সর্বত্র। যেসব জায়গায় বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নিয়েছে, সেখানেই শিক্ষার নতুন পর্ব বিকশিত হচ্ছে। শিকাগোতে হচ্ছে বহু পাঠচক্র, লিখিত হচ্ছে নাটক, গান। দেখা গেল শ পাঁচেক তরুণ বসে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো নিয়ে আলোচনা করছেন। নিউইয়র্কে জুকত্তি পার্কে নিপীড়িতের থিয়েটার, অর্থশাস্ত্র, নতুন অর্থনীতি, দর্শন নিয়ে একের পর এক বৈঠক হচ্ছে। যৌথ জীবন, সামষ্টিক স্বার্থ, ভবিষ্যতের নতুন মানবিক জীবন নিয়ে আলোচনা চর্চা লড়াইকে ভাষা দিচ্ছে, সামনে তাকানোর শক্তি জোগাচ্ছে। এটা ঠিক যে একক কোনো নেতৃত্ব নেই এই আন্দোলনে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে দীর্ঘদিন যেসব ইউনিয়ন বা সংগঠন গড়ে উঠেছে, তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে প্রচার ও যোগাযোগে। এত দিন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কাজ হতো এখন তৈরি হচ্ছে একক লক্ষ্য ও ঐক্যসূত্র। আগামী বছরে শিকাগোতে যে জি-৮ সম্মেলন হতে যাচ্ছে, সেটা নিশ্চিতভাবেই এক বড় লড়াইয়ের ক্ষেত্র হবে।’ 
তিনি আরও বলছেন, ‘এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, যাঁরা আন্দোলনের কর্মী নন, যাঁরা সংগঠক নন, যাঁরা বামপন্থী নন, এটি তাঁদের হূদয়কেও টান দিয়েছে।...আমাদের সংখ্যা বিস্তৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এখন বিশ্বের মানুুষকে জানাচ্ছে যে তারা আর ঘুমিয়ে নেই। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে সংহতি নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছি।’ 
‘আমরা ৯৯%’ এখন সারা বিশ্বের নতুন লড়াইয়ের স্লোগান হতে চলেছে। দখল বলে যে স্লোগান তা আসলে শতকরা ১ ভাগের হাত থেকে দেশ ও ক্ষমতার কেন্দ্র দখলমুক্ত করা। একটি অভিন্ন প্রতিপক্ষ, অভিন্ন বৈশ্বিক লক্ষ্য। আমাদের জন্য এই লড়াই নতুন নয়, দেশ ও সম্পদের ওপর জনগণের শতভাগ মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই তো বাংলাদেশের মানুষ করছেই। এই দুই স্লোগান সারা বিশ্বের, আমাদের।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

‘গণি মিয়া’ ও ‘মুহিত সাহেবের’ মধ্যে তফাত কী?

‘মুদ্রাস্ফীতির অব্যাহত চাপ রেখে সরকারগুলো খুব গোপনে, অলক্ষ্যে তাদের নাগরিকদের সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হজম করে ফেলে। এ পদ্ধতিতে হজম বা বাজেয়াপ্ত করার এ ঘটনা ঘটে নির্বিচারে। এই প্রক্রিয়ায় যখন বহুসংখ্যক মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তখন কিছুসংখ্যক সম্পদশালী হয়।’ কথাটা কেইনস বলেছিলেন ১৯১৯ সালে প্রকাশিত দ্য ইকোনমিক কনসিকুয়েন্স অব পিস গ্রন্থে। অর্থনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত তাই নিছক অর্থনীতির বিষয় নয়, এটা সমাজের শক্তি সমাবেশ ও ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেকের উৎপাদিত সম্পদ কিছুজনের হাতে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া কিংবা কিছুজনের স্বার্থে বহুজনের জীবন বিপন্ন করা কোনো স্বয়ংক্রিয় ঘটনা নয়, তা নির্দিষ্ট নীতি, পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ডের ফল।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ও বিনিয়োগের সংকট এখন একই সঙ্গে চলছে। মূলধারার অর্থশাস্ত্র বলে, মুদ্রাস্ফীতি হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ে। অনেক সময় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর যুক্তিতে মুদ্রাস্ফীতিকে একটি উপায় হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। মুদ্রাস্ফীতির পক্ষে মুদ্রানীতি ও অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু শাস্ত্রের অসুখ ও ওষুধ-সম্পর্কিত এই তত্ত্ব সত্তরের দশক থেকেই বিপদাপন্ন, স্ট্যাগফ্লেশন নামের নতুন আপদ হাজির হওয়ার কারণে। মুদ্রাস্ফীতি যখন বিনিয়োগ-মন্দা কাটানোর ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার কথা, তখন যদি মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগ মন্দা পাশাপাশি চলতে থাকে, তখনই এই বিশেষ সংকটের উদ্ভব ঘটে, তারই নাম স্ট্যাগফ্লেশন। বাংলাদেশে আমরা দেখছি একদিকে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, অন্যদিকে বিনিয়োগে শ্লথগতি দেখা দিচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি অথচ বিনিয়োগের অর্থ নেই! তারল্যসংকট।
বিপুল বিনিয়োগ হয়েছিল শেয়ারবাজারে। চোরাই টাকা তো ছিলই, দেশের সব প্রান্তের সব আয়ের মানুষ যেন তাদের সহায়সম্বল নিয়ে শেয়ারবাজারে হাজির হয়, তার জন্য সরকারই সব রকম ব্যবস্থা করেছিল। ব্যাংক বা সরকারি সঞ্চয়ের সব ক্ষেত্রে সুদের হার কমানো হয়েছিল, জেলায় জেলায় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইত্যাদি। কাজ নেই, দ্রুত আয়ের তাগিদ আর এসব সুবিধায় আকৃষ্ট হয়ে সব রকম সঞ্চয় ও ঋণ নিয়ে মানুষ জমায়েত হয়েছিল শেয়ারবাজারে। তারপর শুরু হলো পতন। খুব দ্রুত দেশের লাখ লাখ মানুষের সম্পদ স্থানান্তরিত হয়ে গেল কিছু ব্যক্তির হাতে। সরকার বলতে থাকল, আমাদের কিছু করার নেই। তদন্ত কমিটি কিছু কারণ বের করল, কিছু গোষ্ঠীকে চিহ্নিতও করল; কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না বলে পণ করেছে। সেই টাকা কোথায় গেল, তারও কোনো হদিস নেই। এ রকম ধারণা করার যুক্তিসংগত কারণ আছে যে সেই বিপুল পরিমাণ টাকা ডলারে পরিণত করে বাইরে পাচার করা বর্তমান ডলারসংকটের অন্যতম কারণ।
মূল কারণ দূর করায় সরকারের অনীহার কারণে দেশের শেয়ারবাজারের আছড়ে পড়া অবস্থারও তাই কোনো পরিবর্তন নেই। ইতিমধ্যে দুজনের আত্মহত্যার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। লাখ লাখ পরিবার অভূতপূর্ব সংকটের মুখে। সম্পদের বদলে তাদের ঘাড়ে এখন ঋণ। স্বাচ্ছন্দ্যের বদলে তাদের এখন হাহাকার। এমএলএম নামের দ্রুত টাকা বানানোর নানা প্রক্রিয়ায়ও অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছে। প্রায়ই তাঁদের হাহাকার পত্রিকায় আসে, শহীদ মিনারে তাঁরা অনশন করেন। সরকার নির্লিপ্ত, মাঝেমধ্যে মুখের দু-একটা কথা। কারণ বোধগম্য, এসবের সঙ্গে নানা প্রভাবশালী লোক জড়িত।
টাকার মূল্যমানের অবনতি গত কয়েক মাসে অনেক দ্রুত ঘটেছে। টাকার তুলনায় ডলারের দাম ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় টাকার অঙ্কে রপ্তানিকারক পোশাক কারখানার মালিক ও প্রবাসীদের আয় বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের আপেক্ষিক আয় কমেছে। অন্যদিকে আমদানি করা দ্রব্যাদির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় থেকে শুরু করে গৃহস্থালির ব্যয়—সবকিছুই বেড়েছে, সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর চাপ বেড়েছে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস দুটি: এক. প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ এবং দুই. তৈরি পোশাক রপ্তানি। এই দুই খাতে দিবারাত্র শ্রম দিচ্ছে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। কোটি মানুষ হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গড়ে তুলছে। আর যাদের ঘরে সম্পদের পাহাড়ের নিরাপত্তার জন্য এই মজুদের বড় অংশ বাইরে চলে যাচ্ছে, তাদের সংখ্যা হাজারও হবে না।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে সরকারেরও উদ্বেগ প্রকাশিত হচ্ছে। তবে তা রূপান্তরিত হচ্ছে আইএমএফের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ সংগ্রহে নানা তৎপরতায়। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান যখন ঋণ দেয়, তার আওয়াজ বহুদিন থেকে চলতে থাকে। ১০০ টাকা ঋণ দিলে তা নিয়ে এতবার এত দিন ধরে কথা হতে থাকে, তা ১০ হাজার টাকার ভাব তৈরি করে। মনে হয় সেটাই একমাত্র উদ্ধারের পথ। আইএমএফের এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ঋণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি, কিন্তু তাদের হাসিমুখ প্রার্থনায় কয়েক দফা তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, সামনে আরও বাড়ানো হবে। আইএমএফ ঋণ দিতে বহুদিন ধরেই ধরনা দিচ্ছে। এসব ঋণ দেওয়ার সঙ্গে তাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। সে জন্য এসব ঋণ নিয়ে কোনো দেশ তার সংকট থেকে মুক্ত হয়নি, বরং আরও ঋণগ্রস্ততার দুষ্টচক্রে পতিত হয়েছে। আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশ তার সাক্ষী।
দেশের বৈদেশিক ঋণ যা ‘বিদেশি সাহায্য’ নামে পরিচিত, তার জন্য আমরা অনেকের হাহাকার শুনি। কিন্তু আমরা যদি বছরে গড়পড়তা নিট বৈদেশিক তহবিলপ্রবাহ বিবেচনা করি, তাহলে তার ১০ গুণ বেশি অর্থ প্রবাসীদের থেকেই আসে। এখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। তার মানে আইএমএফের কাছ থেকে বহু রকম শর্ত ও আওয়াজ দিয়ে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তা প্রবাসীরা প্রতি এক মাসে নীরবে দেশে পাঠাচ্ছেন। আইএমএফ এই ঋণ দেবে তিন বছরে, অনেক শর্ত বাস্তবায়ন করার পর। অর্থাৎ তার প্রতিবছরে ছাড় করা ডলার হবে প্রবাসীদের প্রতি ১০ দিনে পাঠানো অর্থের সমান। তার পরও অর্থমন্ত্রী এই ঋণ পাওয়ার জন্য অনড়। তা নিশ্চিত করার যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তাতে অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়, পরিবহন ব্যয় ও জীবনযাত্রার ব্যয় সবই বাড়ছে, সামনে আরও বাড়বে। টানতে না পেরে ঋণগ্রস্ততার চাপ বাড়ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের।
অর্থমন্ত্রী এতেও ক্ষান্ত নন। তিনি সার্বভৌম ঋণ নেওয়ার তোড়জোড় করছেন। এটা হচ্ছে সার্বভৌমত্ব বন্ধক দিয়ে ঋণ। তাঁর দাবি, এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে! ঋণগ্রহণের ব্যাপারে সরকারের অতিআগ্রহ বহুদিক থেকেই বিপদ ডেকে আনছে। ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য ভারতের কাছ থেকেই ঋণ নেওয়া হয়েছে। যে ঋণ অনুযায়ী ইট-বালু, সিমেন্টও তাদের কাছ থেকেই আনতে হবে। সুদও দিতে হবে, জরিমানাও। উল্লেখ্য, ভারতের জন্য সুবিধা দিতে সরকারের উদারতা সীমাহীন, ট্রানজিট নিয়ে যথাযথ চুক্তি না হলেও তাদের ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য তিতাস নদীর প্রবাহ বন্ধ করে রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে।
দেশের ব্যাংক থেকেও সরকার ঋণগ্রহণে আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এর কারণ হিসেবে বাড়তি তেল এনে বিদ্যুৎসংকট সমাধানের কথা বলা হয়। বরাবরই বাংলাদেশের আমদানির একটা বড় অংশ তেল। এখন তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তেল আমদানিনির্ভরতা বিপজ্জনক। কেননা আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম সব সময়ই অস্থিতিশীল, ভবিষ্যতে আরও হবে। তেল নিয়ে সংঘাত, যুদ্ধ এবং সর্বোপরি ফাটকাবাজারির কারণে এই সংকট আরও বাড়বে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো দেশকে তার নিজের জ্বালানি সম্পদ শতভাগ দেশে রাখতে হবে, কোনো রকম রপ্তানিমুখী চুক্তি যাতে না হয়, এমন ধরনের চুক্তি যাতে না হয়, যাতে ২৫ টাকার গ্যাস ৩০০ টাকায় কিনে বিদ্যুৎ বা গ্যাসের দাম বাড়ে এবং শেষ পর্যন্ত উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে সব নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাস, কয়লা দেশের মধ্যে শতভাগ ব্যবহারের নিশ্চয়তা এবং জাতির সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কম দামে জ্বালানি-শক্তি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু এ দেশের কোনো সরকারেরই সেদিকে মন নেই।
সংকট সমাধান করতে গিয়ে নতুন নতুন সংকটের বোঝা তৈরির নীতির একটি দৃষ্টান্ত রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎসংকটের সমাধানের নামে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদ্যুৎসংকটের সমাধান অস্থায়ী বা খণ্ড খণ্ডভাবে হয় না। তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য অনেক ধরনের বিষয় আছে। স্বল্প মেয়াদে বিদ্যুৎসংকট সমাধানের জন্য অনেক সহজ বিকল্প ছিল। তাতে আমদানিনির্ভরতা বাড়ত না, ঋণগ্রস্ততা এই মাত্রায় যেত না, তেল-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চাপ তৈরি হতো না, আবার দেশের সক্ষমতাও বাড়ত। কিন্তু সরকার তার পরিবর্তে কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখতে গিয়ে দেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও সংকটের বোঝা চাপিয়েছে।
ভুলনীতি ও দুর্নীতির কারণে দেশ যেভাবে ক্রমেই ঋণনির্ভর হচ্ছে এবং সেই ঋণের টাকায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের যে রকম শানশওকত চলছে, তাতে গণি মিয়ার কথা মনে পড়ে। তাঁর গল্প ছোটবেলায় আমরা অনেকেই পড়েছি। ‘গণি মিয়া’ ছিলেন একজন কৃষক। কৃষক হিসেবে তিনি মোটামুটি ভালোই চলছিলেন। কিন্তু ভোগবিলাসের প্রতি তাঁর বিশেষ আসক্তি ছিল। কৃষির আয় থেকে তা সম্ভব ছিল না। গল্পে আছে, তাঁর আসক্তি এতই প্রবল ছিল যে, তিনি ঋণ করে হলেও ঘি খেতেন। ঋণের টাকা খুব সহজ, ব্যয়ের সময় গায়ে লাগে না। কিন্তু ঋণ বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে সুদও। যখন সেই ঋণ শোধ করার সময় হলো তখনই দেখা দিল বিপত্তি। সুদসহ ঋণের টাকা শোধ করতে করতে ফতুর হলেন তিনি। ঋণ করে ঘি খেয়ে শেষে পথে বসলেন কৃষক গণি মিয়া। এই ‘গণি মিয়ার’ সঙ্গে ‘মুহিত সাহেবের’ তফাত কী? তফাত আছে।
গণি মিয়া ঋণ করে নিজে ভোগ করেছেন, নিজেই তার মাশুল দিয়েছেন। কিন্তু মুহিত সাহেবরা যে ঋণের বোঝা তৈরি করছেন, তাতে তাঁর বা তাঁদের কোনো ঝুঁকি বা বিপদ নেই, মাশুলও তাঁদের দিতে হবে না। কতিপয় গোষ্ঠী বা সরকারের কতিপয় লোকজন সুবিধা ভোগ করবে ঠিকই। কিন্তু এই ঋণ ও তার ব্যয় সম্পর্কে জানার বা এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোনো এখতিয়ার যাদের নেই, মাশুল দিতে হচ্ছে ও হবে সেই জনগণকে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

তেল-গ্যাস নিয়ে আত্মঘাতী চুক্তি

আনু মুহাম্মদ

তেল-গ্যাস নিয়ে আত্মঘাতী চুক্তি

জুন ১৫, ২০১১
ছবি. শিল্পী বড়ুয়া
ছবি. শিল্পী বড়ুয়া
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং শিল্প ও বিদ্যুৎসহ জনগণের স্বার্থে তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। জনগণ এই মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন তাদের স্বার্থ দেখার জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য। কিন্তু গত প্রায় দুই দশকে সরকার পরিবর্তিত হলেও এই মন্ত্রণালয়ের দেশবিরোধী ভূমিকার কোন পরিবর্তন হয়নি। তারা একের পর এক যেসব চুক্তি এবং যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে লাভবান হয়েছে কতিপয় বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি এবং দেশি কিছু গোষ্ঠী। কিন্তু দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তা ক্রমেই আরও বেশি বেশি হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের এই ভূমিকার সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে গত মে মাসের প্রথমদিকে সান্টোস ও হেলিবার্টনের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির চুক্তি এবং কনকোফিলিপস-এর সাথে সাগরের গ্যাস ব্লক নিয়ে চুক্তির আয়োজন। সরকার দেশের গ্যাস সঙ্কটকে পুঁজি করে দেশের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের দিকে গেছে। তারা জাতীয় সংস্থাগুলোকে পর্যাপ্ত বাজেট দেয়নি। বিদেশি কোম্পানিগুলো নিজেদের দরকষাকষির শক্তি বাড়াতে অযথাই কালক্ষেপণ করেছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে বিদ্যমান গ্যাস সংকট সমাধানের পথ দেখিয়েছি। বলেছি, দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ান। পুরাতন এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া কূপগুলো মেরামত করুন। বিবিয়ানা থেকে মজুতের তুলনায় বেশি গ্যাস উত্তোলন করতে দেয়া হচ্ছে শেভরনকে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হচ্ছে না। নীতিগত জায়গা ঠিক থাকলে, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি নবায়ন করলে এই সমস্যা মোকাবিলা করে অনেক আগেই গ্যাস সংকট সমাধান করা যেতো।
কিন্তু সরকার সেই পথে যায়নি। সরকার সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে এবং এখন জাতিকে আরো বড় সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। টিকিয়ে রাখা এই গ্যাস সঙ্কটের অজুহাত দিয়ে ‌‌‘তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির চুক্তি’র কারণে অস্ট্রেলীয় কোম্পানি সান্টোস ও মার্কিন কোম্পানি হেলিবার্টন এখন যেকোনো দামে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে। বাংলাদেশ যেখানে ২৫ টাকায় প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস যোগান দিতে পারে, সেখানে উৎপাদন বণ্টন চুক্তির কারণে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে এমনিতেই গড়ে ২৫০-৩০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এই তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির চুক্তির বলে এই সীমাও আর থাকবে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ৭ থেকে ৯ ডলার বা ৫০০-৭০০ টাকাতেও গ্যাস বিক্রির সুযোগ পাবে। অর্থাৎ উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) কারণে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের তুলনায় যেখানে প্রথমে ১০ থেকে ৩০ গুণ বেশি দামে এতদিন বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে আমাদের নিজেদের গ্যাস কিনতে হ’ত সেখানে উপরোক্ত চুক্তির কারণে এখন কিনতে হবে ৫০-১০০ গুণ বেশি দামে। যে দাম দিয়ে আমাদের নিজেদের গ্যাস আমাদেরই কিনতে হবে তা মায়ানমার বা কাতার থেকে গ্যাস আমদানির মতোই ব্যয়বহুল হবে। দেশের বিদ্যুৎ প্লান্ট বা সার কারখানা হয় গ্যাসের অভাবে অচল থাকবে নয়তো এরকম ভয়াবহ দামে গ্যাস কিনতে গিয়ে গ্যাস বিদ্যুৎসহ সব কিছুর দাম বাড়বে। গ্যাস ও বিদ্যুতের অব্যাহত দামবৃদ্ধি এবং তার ফলে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে এসব চুক্তি অন্যতম কারণ। সামনে তার চাপ আরও বাড়বে।
গ্যাস খাতে এখনই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে ভর্তুকি দেয়া হয় দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি। এখনকার চুক্তিগুলো এই পরিমাণ আরও বাড়াবে। নিজেরা করলে এর এক-দশমাংশ দিয়ে একই পরিমাণ গ্যাস পাওয়া সম্ভব ছিল। ঝুঁকি হিসাব করেই এটা সম্ভব ছিল। তাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ সহজপ্রাপ্য ও সুলভ দুটোই হতো। বাপেক্সকে তার অর্জিত টাকা নিজের উন্নয়নে খরচের অনুমতি দেয়া হলে সে অত্যন্ত দক্ষ ও সক্ষম একটি আন্তর্জাতিক মানের জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো। জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে যদি ‘সুনেত্র’ (সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা) গ্যাস কূপ উন্নয়ন করা হয় তাহলে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের আশু কোন সম্ভাবনা থাকবে না। বাংলাদেশের মালিকানায় গ্যাস উত্তোলনের জন্য যে গবেষক ও যন্ত্রপাতি দরকার তা জাতীয় সংস্থাকে দেওয়া হলে বর্তমান জ্বালানি বাজেটের অর্ধেক বরাদ্দে জ্বালানি খাতের টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব।
বিদেশি কোম্পানির দেশীয় মুখপাত্ররা সবসময়ই বলেন, ‘আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে’। অথচ আমরা দেখেছি বহুজাতিক অক্সিডেন্টাল আর নাইকো মিলে মাগুরছড়া আর টেংরাটিলার প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নষ্ট করেছে। আমরা শেভরন ও নাইকোর কাছে এই ধ্বংসযজ্ঞের জন্য যে পরিমাণ টাকা পাই তার বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ আদায় করবার জন্যও কোন উদ্যোগ কোন সরকার নেয়নি। সরকারের কাছে এরাই হচ্ছে দক্ষ। আর সরকারের কাছে অদক্ষ হলো বাপেক্স; যারা কখনো এরকম কিছু ঘটায়নি। দক্ষতা আকাশ থেকে পড়ে না, তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ও ব্যবস্থা নিতে হয়। সুযোগ দিতে হয়। ভিশন ও অঙ্গীকার থাকতে হয়।
আর্থিক রক্তক্ষরণ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং অর্থনৈতিক বোঝার এসব চিত্র থাকা সত্ত্বেও ৮০ ভাগ রপ্তানিমুখী চুক্তির মাধ্যমে কনোকোফিলিপস-এর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে সমুদ্রের গ্যাস ব্লক। এই কোম্পানির আছে বহু দুর্ঘটনার রেকর্ড । সম্ভবত সেকারণেই দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের বিষয়টি কনোকোফিলিপসের সাথে চুক্তিতে যতটা সম্ভব অস্বচ্ছ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে পুঁজির অভাব। কত বিনিয়োগ করবে তারা? পাঁচ বছরে ১১০ মিলিয়ন ডলার বা ৭৭০ কোটি টাকা। এই টাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়তনের তুলনায় তুচ্ছ। এক বছরে এমপি আমলাদের জন্য সরকারি গাড়ি কেনার বাজেটই এর চাইতে বেশি। অথচ খোড়া যুক্তি দিয়ে সমুদ্রের সম্পদ তুলে দেয়া হচ্ছে এই মার্কিনী কোম্পানির হাতে। শতকরা ৮০ ভাগের মালিকানা তাদের, এই গ্যাস তারা এলএনজির মাধ্যমে রফতানি করতে পারবে– এই অধিকারও চুক্তিতে দেয়া আছে। দুর্ঘটনার দায় থেকেও তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, তারা আগে পেট্রোবাংলাকে অফার করবে, কিন্তু নিজেরা পাইপলাইন তৈরি করে ভূখণ্ডে আনার চাইতে বিদেশ থেকে আমদানি করাই বেশি যুক্তিযুক্ত দেখানো হবে তখন। বলা হচ্ছে কনকোফিলিপস মেজারমেন্ট পয়েন্ট পর্যন্ত গ্যাস পৌঁছে দেবে। কিন্তু চুক্তিতে মেজারমেন্ট পয়েন্ট কোথায় হবে এটা সুনির্দিষ্ট করা নাই। পরে দেখা যাবে মেজারমেন্ট পয়েন্ট সাগরের মাঝখানে। চুক্তিতে ফাঁক থাকলে তা তাদের পক্ষেই যাবে। কারণ মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলার শীর্ষ কর্মকর্তা, ও কনসালট্যান্টরা বারবার প্রমাণ করছেন তারা কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতেই জান কোরবান করছেন। তারা আমাদের জন্য গুপ্তঘাতক।
আসলে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ এবং আমাদের জাতীয় প্রয়োজন কখনোই এক হতে পারে না। তাদের দরকার যত তাড়াতাড়ি ও যত বেশি সম্ভব গ্যাস উত্তোলন করে তা বিক্রি করে উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা, সেজন্যেই তারা রফতানির বিধানসহ গ্যাস বা কয়লা নিয়ে চুক্তিতে আগ্রহী। আর আমাদের দরকার, প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস তুলে যতদিন সম্ভব তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। সেজন্যই জাতীয় মালিকানা ও জাতীয় সক্ষমতার প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যে কাজ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তাদের করার কথা এখন তা করছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এবং কতিপয় কনসালট্যান্ট। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ দেখার কারণে তাদের পক্ষে এটা বোঝা অসম্ভব হচ্ছে যে, বিদেশি কোম্পানির মালিকানায় সীমিত নবায়নযোগ্য জ্বালানিসম্পদ রপ্তানির সুযোগ থাকা মানেই দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করা। বহুদেশ এই পথে আজ চরম সংকটে। অনেকে বলছেন, রপ্তানির বিধান না রাখলে বিদেশি কোম্পানি আসবে না। যা না রাখলে তারা আসবে না – তা তারা করবে না, এটা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? তাহলে খনিজ সম্পদ রফতানি নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণয়ন করতে বাধা কোথায়?
সবমিলিয়ে কনোকোফিলিপস-এর সঙ্গে পিএসসি ২০০৮ এর অধীনে সমুদ্রের গ্যাস ব্লক নিয়ে যে চুক্তি করতে যাচ্ছে সরকার, তার কারণে ভয়াবহ একটি পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চুক্তির দলিলেই বলা হচ্ছে বাংলাদেশ কোনভাবেই ২০ ভাগের বেশি পাবে না। সেটাও সমুদ্র বক্ষ থেকে ভূসীমায় আনতে গেলে বাংলাদেশকে ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। তরলায়িত করে(এলএনজি) কনোকোফিলিপস এই গ্যাস রফতানি করতে পারবে। এর পরিণতি হল গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশের শতভাগ গ্যাসই পাচার হবে বিদেশে। সমুদ্রের বিশাল সম্পদসহ অন্যান্য ব্লকগুলোও ক্রমে এ ধরনের চুক্তির অধীনে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাবে। সমুদ্রসীমা এখনও নির্ধারিত হয়নি। ভারত আমাদের সীমার একাংশ দাবি করে রেখেছে, বাকি অংশ যাচ্ছে মার্কিনীদের হাতে। মার্কিন কোম্পানির নিরাপত্তার অজুহাতে মার্কিনী নৌ-বাহিনীর কর্তৃত্ব স্থাপিত হবে বঙ্গোপসাগরে। জ্বালানি ও জাতীয় নিরাপত্তা দুটোই বিপর্যস্ত হবে।
১৫ জুন ২০১১
আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ।